Tuesday, July 9, 2019

31) বাঙালীর নিরামিষ প্রীতি


বাঙালীর নিরামিষ প্রীতি 
বাঙালি নাকি শুধুই আমিষ খায় ! বাঙালির মঙ্গল শনিবারে নাকি অম্বল হয়। বাঙালির কি সত্যি নিরামিষ বলে কিছু নেই ? সব আছে , শুধু ল্যাদখোর বাঙালির সংখ্যা বেশি। তাদের জ্ঞানবৃদ্ধির একটু প্রচেষ্টা করলাম। ..... 
---------------------------------------------------
বাঙালীর নিরামিষ প্রীতি 
ভেজ(veg) ভ্যাজাল নয় 
অর্ক ভট্টাচার্য 

বাঙালীরা কি খায় ? বং মম কুক বুক এর লেখিকা সন্দীপা মুখার্জি লিখেছেন "Anything and everything as long as it is being followed up by Gelusil, Pudin Hara, Joan er Aarak or Nux Vom 30." এর থেকে ভালো বিবরণ আমি আর কোথাও পাইনি। আমরা যা ইচ্ছা খাই। যখন ইচ্ছা খাই। কোনো বারণ নেই। সত্যি কি নেই ? না আছে। আছে বোধহয়। শনি মঙ্গলবার অনেকেই মানে। আবার বৃহৎ নাস্তিক বাঙালি সম্প্রদায় সেসবের তোয়াক্কা করেন না। যেহেতু স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার আমাদের পাতের শোভা , তাহলে অবতারের বাহন কেন থালায় গড়াগড়ি খাবে না। বাংলার বাইরে বাঙালিদের খাওয়া নিয়ে চলিত কথা আছে , "জো চলতা হ্যায় হাম খাতে হ্যায়। " মানে শুধুই নন -ভেজ। 

আমরা যেন ভেজ বলে কোনো বস্তু খাইনা ( অথচ পিঁয়াজ , রসুন এমনকি মুসুর ডাল আমাদের আমিষ ) আমরা ঠিক এরকম প্রচার করে এসেছি বিশ্বমাঝে। আমরা প্রাচ্যের সেই পচা মাল, "হু স্টেয়ার্স এট গোট " কথাটা কি গায়ে লাগলো। না লাগিয়ে ভাবুন , রবিবারের কচি পাঁঠার ঝোলের পরের ঘুম টা। বাহাত্তর হুরী না পেলেও কত পরী যে ঘোরে ওই ঘুমে সে আর বলতে। ছাগল জন্মায় বাঙালির জন্যেই। আর মুরগী , সে তো সত্যি মুরগী। আজকাল মনেই হয়না মাংস খাচ্ছি। কচুর তরকারিতে কচুর পিসের মতো হয়ে গেছে। 

তাহলে বাঙালি কি সত্যি নিরামিষ খায়না , না পছন্দ করেনা। বাঙালির নাকি শনিবার অম্বল হয়। তার কারণ কি নিরামিষের প্রতি মানসিক অবসাদ , নাকি ময়দার অতিরিক্ততা অম্লশূলের ফুল ফেলা। ভিগান গার্লফ্রেন্ড ছাড়া বাঙালি কি ভেজ রেস্টুরেন্ট এ ঢোকে না, নাকি ঘাসপাতায় পয়সা দিতে বাঙালি নারাজ। শাক খেলে বেশি পায়খানা হয় বলে কি মাংস ঠুসে কোষ্ঠকাঠিন্যপ্রেমী বাঙালি অম্লজীন চূর্ণর প্রতি প্রেম নিদর্শন করে। মাছে ভাতে বাঙালির নাম খারাপ হয়ে যাবে বলে কি জাত্যাভিমানী বাঙালি মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না। না , পুরোটাই ভুল। আসল ব্যাপার হলো খাদ্যরসিক বাঙালির থেকেও ল্যাদখোর বাঙালির সংখ্যা অনেক বেশি। অথচ বাঙালির নিরামিষ বেশ পরিশ্রম সাপেক্ষ তাই চরিত্রের গোবর ঢাকার জন্য সামগ্রিক ভাবে এই ব্যবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে । 

সমস্ত জাতিই খাদ্যপ্রিয়, কিন্তু বাঙালি খাদ্যরসিক। তাই বাঙালির খাদ্য আদা , রসুন , লঙ্কা , ধনে , জিরের ঘ্যাঁটের গোবরে লেপ্টে থাকা সেদ্ধ তরকারি নয়। সূক্ষতা আছে। বাঙালির নিরামিষ রান্নায় লাগে ধৈর্য্য , সময় আর পরিমানের জ্ঞান। কেটে, কুটে , তেলে ছেড়ে, নাড়িয়ে নেওয়ার রান্নায় বাঙালি নেই। 

অনেক বাংলার বাঙালিকেও এই হাওয়ায় ধুনো দিতে দেখি। আর দেখলেই বলি , " লাস্ট কবে মোচা খেয়েছিস ? " উত্তরে একই প্রতিধ্বনি , " ছাড়াবে কে ? " সত্যি তো, মোচার ঘণ্ট খেতে গেলে কষ লেগে নখ নষ্ট হয়ে যাবে না। তার থেকে চিকেন কারি। কিন্তু মনে প্রাণে বাঙালির সারা দিন যদি খাওয়ার ফিরিস্তি শুনতে হয় তাহলে কিন্তু একটা মাছের পিস , আর এক বাটি মাংস ছাড়া বাকি সবই গাছগাছালি। 

বাঙালির ঘুম ভাঙে রাতে ভিজিয়ে রাখা চিরতা , যষ্টিমধু , বা দুলাল চন্দ্র ভরের তালমিছরির জল দিয়ে। ভুরভুরে দার্জিলিং টি ( ওই সিটিসি brook বন্ড ফাঁকিবাজদের জন্য , কারণ পাতা চা ফোটানোর পর ভেজাতে হয় , আর তাতে লাগে সময় ) আর মেরি বিস্কুট। কখনো কখনো টোস্ট বা লেড়ো বিস্কুট ( কতজন ভুলেই গেছে ) । মর্নিং ওয়াকে খেজুরের রস। আর কখনো কখনো তালশাঁস। শতশতাংশ নিরামিষ মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে ভেসে আসা সিঙ্গারা , রাধাবল্লভীর গন্ধে মম করতে থাকে সকালের বাতাস। কোথাও শালপাতার প্লেটে কচুরির ওপর এসে পরে আদা বাটা দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি আলুর তরকারি। সাথে মিষ্টি তো আছেই। 

বাঙালির মিষ্টির দিকে তাকাতে গেলে তো চিকেনের ঠ্যাং , পাঁঠার রাং সবই ভুলে যেতে হয়। সারা বিশ্বে যখন "এগ না দিলে ফ্লাফি " হবে না বলে এগলেস কেকের স্বাদমূল্য বিচার করতে মারামারি করে তখন বাঙালি তার ছানার কেক দিয়েই পাগল করে দেয়। থাক, মিষ্টিতে ঢুকবো না , এ নিজেই এক জগৎ। 

মধ্যাহ্নভোজে , যেমন মাছে ভাতে বাঙালি ঠিক তেমনি শাকে ভাতে বাঙালিও বটে। বাঙালি যদি কোনোদিন থালি পরিবেশন করে, তাহলে তার অতি নিম্ন পর্যায় থাকবে পঞ্চব্যঞ্জন যা পঞ্চ ইন্দ্রিয় তুষ্ট করে। চোখ দিয়ে বাসন্তী পোলাও দেখে , কুড়মুড়ে আলুভাজার শব্দ শুনে , গন্ধরাজের ভুরভুরে গন্ধ আঘ্রান করে , খেজুর গুড়ের পায়েসে হাত ডুবিয়ে , হাজার ব্যঞ্জনের স্বাদ নিতে নিতে মানুষ তূরীয় আনন্দ উপভোগ করবে। 

বাঙালির খাওয়া শুরু হয় তিতা বা তেতো দিয়ে। উচ্ছেভাজা , নিমবেগুন , পলতা পাতার বড়া বা ঝুরঝুরে শিউলি পাতা শুকনো ভাতে মেখে মুখটাকে একটু তেতো করে নিতে হয়। শুক্তো আসে তার পরে। শুক্তোকে তেতোর মধ্যে ফেলা হলেও অনুষ্ঠান বাড়ির দুধ বা মালাই দেওয়া শুক্তো কিন্তু মোটেও তেতো হয় না। এই শুক্তো আমার ছোটবেলায় ভালো লাগতো না। ভোট দেওয়ার বয়স হওয়ার পর ভালো লাগতে আরম্ভ করলো। আসলে এর স্বাদ বয়স বাড়লে বাড়ে। সে যাইহোক তেতো মুখে নাকি সবই নাকি ভালো লাগে। ঠিক যেমন পারফিউমের দোকানে এক একটা গন্ধ শোঁকার পর কফি বিনস শুঁকতে বলে। 

তেতো কণ্ঠস্থ করার পরে আসে কষা। থোড় ভাজা , বা থোড়ের ডালনা , কখনো এঁচোড়। এঁচোড় বলতেই চিংড়ি সুরসুর করে ঢুকে পড়লেও নিরামিষ এঁচোড়ের কিন্তু জুড়ি মেলা ভার। এঁচোড় আবার এক তালুর এঁচোড় যা কুচি কুচি করে ডালনা করা হয় তার স্বাদ আমার মনে হয় বুকো এঁচোড়ের থেকে অনেক ভালো। কিন্তু এঁচোড় না পাকলে কাঁঠাল বীচি আসবে কোথা থেকে। আর কাঁঠাল বীচির স্বাদ কি আর বলে বোঝানো যায় রে পাগলা। 

তেতো ও কষার মাঝে আসে ভাজা। বাঙালির ভাজার বিবরণ দিতে গেলে ভোর হয়ে যাবে। জন্মদিনের পাঁচ ভাজাতে মায়েরা ফাঁকি মেরে মাছ ভাজা ঢুকিয়ে দেয় বটে। কিন্তু ভাজা শুরু হয় আলু দিয়ে , কখনো গোল , কখনো ঝুরঝুরি। আলুর খোসা , লাউয়ের খোসা ভাজা পোস্ত দিয়ে। পটল ফালি , বা গোটা পটলের ধার চিড়ে চিড়ে। ন্যাতানো মিষ্টি কুমড়ো , বা কুড়মুড়ে কচু ভাজা। কখনো থাকে সাবুর পাঁপড় বা ডালের পাঁপড়। কখনো বেগুন জামা ছাড়া গোল গোল , কখনো জামা পরে বেগুনি , কেউ নাম দেয় পোড়ের ভাজা। ছোট বড়িও থাকে কুড়মুড়ে, হাতে গুঁড়িয়ে ভাতে মেখে নিতে হয়। সাদা বকফুল , হলুদ কুমড়োফুল চালের গুঁড়ির ব্যাটারে চুবিয়ে খাসা লাগে। 

ভাজার সাথে থাকে শাক আর কিছু শাকের সাথে আসে কাসুন্দি। মেথি , পালং , কলমি , বেথুয়া , পুঁই এগুলো তো রোজকার শাক। কাটো রসুন দিয়ে ভাজো খাও। পুঁই , পালংয়ের মিষ্টি চচ্চড়ি ছাড়াও পুঁই পোস্তও হয়। কিন্তু বাঙালির আরো শাক আছে।আছে নাল নাল পাটশাক , আছে বাদাম দিয়ে লাল শাক , কাটোয়ার ডাঁটা , বুদ্ধিমতী ব্রাম্হি , আর পেট বাঁচানোর কুলেখাড়া। শাক ছাড়াও পাতা বেটেও ঝোল হয় যার উদাহরণ গ্যাদাল পাতা। কালো সেই ঝোলে হয়তো রসনার পরিতৃপ্তি অতোটা হয় না কিন্তু শরীরে লাগে। 

ডাঁটার কথা যখন উঁকি দিলো তখন সজনে নাজনে ছাড়লে হয়। ফুল হওয়া থেকে ধাওয়া করি আমরা এই গাছের পিছনে। ফুল হলেই কুচিয়ে ভাজা , কিছু ফুল তাও টিকে থাকে আর ধেয়ে আসে সবুজের স্রোত কচি ডাঁটার রূপ নিয়ে। লাউডগা সাপের হাত বাঁচিয়ে যখন নরম নরম সেই ডাঁটার পোস্ত হয় তখন আর কিছু চাইনা ভাতে। এদের শেষ করলেও কিছু বেঁচে যায়। মোটা মোটা বেতের মতো। কোদাল দিয়ে চাঁচা যায় এই ডাঁটার ভেতরের অংশ। 

তখন থেকে পোস্ত পোস্ত করছি। ঘটির মরণ তো। কি আর করবো। পোস্ত ছাড়া বাঁচবো না। তাই পোস্ত নিয়ে আরেকটা লেখা আলাদা করে লিখেছি। এই ঘটিদের কাছে পোস্ত একটা অন্য ক্যাটাগরি - আমিষ , নিরামিষ , পোস্ত - তৃতীয় নেত্র। খুললেই ছবি। পাঞ্জাবিদের ওই আদা রসুনের মসলার মতো , যা পারো ঢালো - অমৃতের ছোঁয়ায় সবই স্বর্গীয়। 

পোস্ত থেকে পেছন ফিরে আসা অপমানকর তাই পোস্ত বাটা দিয়ে ঢুকে যাই বাটাতে। শিলে বাটো বা মিক্সিতে। বাটা মানে সেই থকথকে চটচটে পদার্থ, যা লেগে যাবে শুকনো এবং গরম ভাতের দানার গায়ে। সিম , পটল , পোস্ত আর কচু এই বাটাই আমি খেয়েছি। আরো অনেক কিছুই হতে পারে। খাইনি তাই লিখছি না। এই বাটার ঢলানি ভাব থাকে "ভাতে"ও । আহা ভাতে মানে , ভাতে দিয়ে সেদ্ধ। ওই আলু ভাতে , পেঁপে ভাতে , কুমড়ো ভাতে , আর সবথেকে পাগল করা গন্ধরাজ লেবু আর সর্ষের তেল দিয়ে ওল ভাতে। আলু ভাতের নিজস্ব জগৎ আছে আর বিশ্বব্যাপী তার গুণকীর্তন আছে। বাটার আর চিস দিয়ে বিদেশী ম্যাশড পটেটো বা লিট্টির সাথে আলু ছোঁকা একপ্রকার আলু ভাতে হলেও বাঙালির আলুভাতে মোটামুটি চার রকম। শুকনো লঙ্কা আর জিরে তেলে ভেজে , শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে , কাঁচা লঙ্কা আর পিয়াঁজ দিয়ে , আর স্রেফ নুন কাঁচা লঙ্কা আর সর্ষের তেল দিয়ে মেখে। আমার মতো অনেকে আছে যারা পেঁপে ভাতে আর ভিন্ডি ভাতে খেতে ভালোবাসে , যদিও ওটা একান্তই রুগীর খাবার, কিন্তু সত্যি বলতে কি , আবার বলছি , কিছু টেস্ট ডেভেলপ করতে হয়। 

ভাতের পর আসে ভাপা। ভাপার নাম আসলেই ইলিশ বা ভেটকি আসে বটে কিন্তু নিরামিষেও সহস্র ভাপা আছে। স্বয়ং পিঠে পুলির অধিকাংশই তো ভাপা। মোমো ডাম্পলিং এর বাঙালির নিজস্ব ভার্সন পিঠেপুলি কিন্তু আগাপাশতলা নিরামিষ। যদিও অনেক ক্ষেত্রে সেই পাঁঠার ঝোল বা শুঁটকি সহযোগে খাওয়া হয় বটে। কিন্তু অধিকাংশ সাইড কিক , মানে ঝোলা গুড় বা পায়েস কিন্তু নিরামিষ। পুলি যদিও ভাপা, ভাজা , দুধ আর রস পুলি হয়। কিন্তু পিঠা বা পিঠের সংখ্যা অগণিত। আসকে , কুলি , গোকুল , চুটকি , ছিটকা , আন্দোসা , বিবিয়ানা , নকশি এসব নাম তো আছেই। এমনকি মালপোয়া বা পাটিসাপ্টা কিন্তু আসলে একপ্রকার পিঠাই। সবই নতুন চাল গুঁড়ো সেদ্ধ করে পুর ভরার খেলা। 

ধোঁকা আরেক নিরামিষ ভাপা। যদিও অনেকে না ভাপিয়েও করে। এই ধোঁকা দিয়ে বাঙালির ডালে ঢুকে যাই। ডাল রাইস বাঙালির পাতে থাকে না। কারণ যে ডাল রাইস আপামর উত্তর ভারতীয়রা খায় তা অত্যন্ত মশলাপ্রণীত। বাঙালির ডাল হালকা। আর অড়হর বা তুয়ার ডালের আধিপত্য কম। মূলতঃ মগ মুসুর আর ছোলার ডালে আমরা জীবন অতিবাহিত করি। যদিও আলুপোস্তর সাথে মৌরি ফোড়ন কলাই ডাল রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়। যেহেতু প্রাচীনধর্মী বিধবারা মুসুর ডাল খায় না, তাই মুগ ডাল ভিজিয়ে বা মটর ডাল ভাতে দিয়ে তাদের দিন কাটে। লুচির সাথে মিষ্টি মিষ্টি ছোলার ডাল আর বিয়ে বাড়ির শীতের সবজি আর গরম মসলা দেওয়া মুগের ডাল মনে হয় বাঙালির দুইমাত্র মসলা দেওয়া ডাল। এছাড়াও তিতা ডাল বা উচ্ছে-নিমের ডাল , বা টক ডাল বা আম-চালতার ডাল বাঙালির চূড়ান্ত প্রিয়। এক বিশাল সংখ্যক ব্যাচেলর শুধু ডাল ভাতে আলু ভাতে ঘি ভাতে ভাত খেয়ে জীবন অতিবাহিত করে। নতুন জায়গায় যখন কেউ যায় তখন প্যাকেট করে মুসুর ডাল , চাল , ঘি আর নুন নিয়ে গেলেই অন্তত ভাত প্রিয় বাঙালির মস্তিষ্ক ঠিক থাকে। 

ডাল যখন এসেই পড়লো তখন সাথে তরকারি নিয়ে কথা বলা যাক। ডালনা , দোলমা , কোফতা , ঘণ্ট , ছ্যাঁচড়া , লাবড়া, ছেঁচকি সবই বাঙালির তরকারি। ডালনা মানে ডাল-না থাকলে যেটা দিয়ে মেখে খেতে হয়। ধোঁকা , ফুলকপি , আলু পটল বা এঁচোড়। মধ্যপ্রাচ্যের দোলমা যখন বাঙালির পটোলের মধ্যে ঢুকে পরে তখন বাঙালি ভুলে যায় এ স্বাদ তার নয়। ঘন্ট অর্থাৎ ঘ্যাঁট বা থকথকে এক তরকারির এক অদ্ভুত নাম শুনেছিলাম ছোটবেলার গ্রামে - মলম। লাবড়া আর ঘন্ট যদি প্রচুর সময় ধরে সেদ্ধ করা হয় তাহলে এক মলমের আকার নেয়। গরম তেলে ছাড়া সবজির ছ্যাঁক ছ্যাঁক আওয়াজে তৈরী হওয়া কুমড়ো , বা ছোলার ছেঁচকি , কাঁচকলার কোফতা বাঙালির আমিষ রান্নার থেকে অনেকগুন্ সুন্দর। 

পূর্ণাঙ্গ নিরামিষ বা স্বনামধন্য আমিষ খাবার শেষ পাতে কিন্তু সেই জ্বলজ্বল করে নিরামিষ টক , চাটনি বা মিষ্টি আঁচার। আম , আমড়া , চালতা , টমেটো , জলপাই , কামরাঙ্গা , আলুবোখরা , রাঙালু যা পাই তাকেই একটু ফোড়ন দিয়ে ভেজে চিনির রসে ফুটিয়ে যতক্ষন না টক বা চাটনির নাম দি ততক্ষন ভাত সত্যি হজম হয় না। সারা দেশ যখন চাটনি মানে পুদিনা আর ধনেপাতা বোঝে আমাদের বিস্তার অন্য লেভেলের। দই মিষ্টির কথা বলে ভরাট না করে , বিকেলের চাটের দিকে এগিয়ে যাই তাহলে দেখবো আধুনিক পাশ্চাত্য পশ্চাৎ লেহন সভ্যতার অসভ্যতায় নিরামিষের পরিবর্তে এসেছে আমিষ। 

ভেবে দেখো , ফুচকা , চপ আর ঝালমুড়ি - এর তুলনায় কি ফ্রায়েড চিকেন , বার্গার আর ফ্রাঙ্কি আসে। কুল চশমা ছেড়ে "ও মাই গড - ইটস টু হাট " বলে এখনো ফুচকা খেয়ে ন্যাকামো দেখানোর সুযোগ কিন্তু সেই নিরামিষই করে দিয়েছে। "এই মুড়িজ্জাল মশলা মুড়ি - এই মুড়ি মুড়ি " আগে ছিল ঠোঙায় , খেতে হত হাতে করে এখন একটা বাটাটা বা প্লাষ্টিক এর চামচ দিয়ে দেয়। কিন্তু সেই মুড়ি এখনো সেইই আছে। বাঙালির মুড়ি খাওয়া যে ইতিহাস সে বলতে অনেক সময় লাগবে। 

এ গাথা শেষ করা সম্ভব নয়। অনেক লিখলেও অনেক বাকি থেকে যাবে। আজ ল্যাদখোর বাঙালির স্বাদে বিকৃত বিপণির বিক্রয়। বাঙালি অথচ ভেজ ও সিগারেট খায় না সেটা দেখা যায় না এটা ভুল। এক বিশাল সংখ্যক নিরামিষ বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মানুষ এখনো বেঁচে আছে শুধু নিরামিষ খেয়ে। বাঙালির মৎস্যপ্রীতি চিরন্তন, কারণ নদীমাতৃক সভ্যতা বলে। মাংসপ্রীতির সংজ্ঞা বছর পনেরো আগেও ছিল রবিবারের দুপুর। হঠাৎ করে এই অতিরিক্ত মাংসপ্রীতি বৈদেশিক খাদ্য ব্যবসায়ীদের সৃষ্ট মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্রের আভাস দেয়। বাঙালি খাদ্যপ্রেমী , ভোজনরসিক - সাথে সাথে এই জটিল রন্ধনে প্রদত্ত পরিশ্রমে উদ্যোগী ছিল। যারা এখনো আছে তাদের কাছ থেকে নিরামিষ রান্নার প্রতি কটাক্ষ অপেক্ষা করবো না। আগে মানতাম , এখনো মানি , কুঁড়ে দের অজুহাত প্রচুর আর তাতে স্বাদ বিসর্জন করে পরধর্মে হাত মেলাতেও তাদের গায়ে লাগে না। ভালো রান্না করতে না পারা অপরাধ নয় . কিন্তু দুটো চিকেন ঝোল বানিয়ে "অথেন্টিক বেঙ্গলি " ইউটিউব চ্যানেল খোলা রীতিমতো শাস্তিযোগ্য। তাই বাঙালি যে শুধু পরমাংসে নাল বর্ষায় না , গাছগাছালিতেও সম উদ্ভাবনী শক্তি রাখে তা মনে রাখতে হবে। 

আর কি , তাহলে থামুন , ঘামুন আর শরীরের দিকে নজর দিন - গোবর গুহ হতে হবে না। অন্তত পেটরোগা বা কনস্টিপেশনে না বেঁচে আর কূপমণ্ডুক ল্যাদখোরদের কথা না শুনে ভালো রান্নায় মনোযোগ দিন। 

বাকি প্রবন্ধ গুলো