Sunday, April 19, 2020

#গো_করোনা_গো (১৭) - শিশু যখন গৃহবন্দী

বাইরে জমে থাকা বরফ গলে গেছে অনেক দিন।  সকালে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।  কোকিল তো এখানে ডাকে না।  কিন্তু বসন্তের পাখি অনেক আছে।  তারাই গাইছে।  স্নো বুট ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে।  জ্যাকেটও এখন পাতলা।  লনে গজিয়েছে ঘাস।  এখন বাচ্চাদের বেরিয়ে আসার সময়।  তারা বেরিয়ে আসবে দলে দলে।  মাঠে ঘাটে পিল পিল করে ভিড় জমাবে।  খেলবে , কাদা মাখবে , ঘামে চপচপে হয়ে বাড়ি ফিরবে লাল টমেটো হয়ে।  প্রতি উইকেন্ড এ হবে নানা টুর।  বাবা মা কে বগলে নিয়ে ঘুরতে যাবেন মহাশয়রা।  চড়বেন পাহাড় , পুঁতবেন গাছ।  আরো কত কি।  কিন্তু এ বছর হয়তো আর কিচ্ছু হবে না।  

আমার ছেলে এখন ফাঁকা কমিউনিটি তে ডেলিভারি গাড়ি থেকে বেরোনো লোকেদের দেখলেই ঘরের ভেতর থেকে চিৎকার করে , “হ্যালো - ও -ও ও। …….হ্যালো - ও -ও ও ” উত্তর আসেনা।  সে সামনের মাসে চারে পড়বে।  তার এখন সাংঘাতিক ছুটে বেড়ানোর সময়।  আর সে মানুষ ভালোবাসে।  দূর থেকে বাচাদের কলরব শুনে “চিলফ্রেন চিলফ্রেন ” ( ফ্রেন্ড আর চিলড্রেন একসাথে) বলে দৌড়ে যেতে চায়।  কিন্তু সে পারেনা।  

কি অসহায় অবস্থা।  নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তার দুটো স্কুল ছিল।  একটা ডে কেয়ার , একটা স্কুল।  তার চারপাশে ছিল প্রচুর মানুষ।  নানা রঙের , নানা বৈচিত্রের নানা কর্মকান্ডের মানুষ।  এখন তার হাতে শুধু বাবা আর মা , আর দুজনেই কর্মরত।  তাদের ওয়ার্ক ফ্রম হোমে বাধা দিলেই জুটছে কপালে চিৎকার।  বেরিয়ে আসছে কান্না।  অপরাধবোধে জড়িয়ে থাকা আদরের কিছু মুহূর্ত বাদ দিয়ে কিই বা তারা দিতে পারে। এবার তার দাদু দিদা , ঠাম্মা -দাদুর কাছে যাওয়ার কথা ছিল , তারাও এখনো সেই ফোন বন্দী।  রোজ যখন কথা হয় , তখন তাদের দুশ্চিন্তা ভরা মুখ দেয়না তাকে আনন্দ।    

তার ছিল রাশি রাশি খেলনা।  না বাড়িতে নয়।  যেহেতু সেও বড়দের মতো অফিস করে।  তার দুই স্কুলে ছিল ভর্তি ভর্তি খেলার সামগ্রী।  আমাদের পক্ষে সেই খেলনার সমকক্ষ খেলনা কেনা অসম্ভব।  তার ছিল বল পিট্।  সেখানে গিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতো। তার ছিল বিশাল বড় বড় প্লে এরিয়া।  যেখানে স্লাইড করতে পারতো , দোলনা চড়তে পারতো।  আর পারতো ছুটে বেড়াতে।  তার কাছে এখন একটা ছোট্ট স্লাইড।  যেটাতে সে আঁটে না।  কিন্তু তাই দিয়েই চলছে।  একা একাই।   লাইন নেই , দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার ব্যাপার নেই।  নেই বন্ধুদের সাথে দৌড়ানোর ব্যবস্থা।  আছে বাবা , ছুঁড়ে দিচ্ছে বল, আর ডুবে যাচ্ছে মোবাইল নয়তো ল্যাপটপে।  

তার পছন্দ ছিল বই।  একের পর এক বই নিয়ে আসতো বাবা।  লাইব্রেরি থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত কুড়িটা করে নানা রঙের বই এসে হাজির হতো তার ঘরে।  বাবা অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে একের পর এক বই পরে যেত তার কানের কাছে।  কিন্তু এখন লাইব্রেরি বন্ধ , নতুন বই আর আসছে না।  সেই পুরানো বই নিয়েই নাড়া ঘাঁটা।  এই এক মাসে সব মুখস্ত হয়ে গেছে।  

তার স্কুলে ছিল আর্ট টাইমের নোংরা করার আনন্দ।  কৌটো কৌটো রং , মুঠো মুঠো রং পেন্সিল, হাজার হাজার ডু ইট ইওরসেল্ফ একটিভিটি।  গায়ে এপ্রোন পরে দু হাত রঙে চুবিয়ে ছাপ দিতো সে সাদা কাগজের ওপর।  আজ একটা রঙের ডিবি থেকে একটু রং বার করে একটু খেলার পরেই তাকে ক্লিন করতে হয়।  কড়া নজর , কার্পেটে না পরে। 

যেহেতু মাঠে খেলতে পারবে না তাই মাঝে মাঝে গাড়িতে চাপিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি ফাঁকা রাস্তায়।  মুখ থেকে দীর্ঘশ্বাসের পর বেরিয়ে আসে , “নো স্কুল , নো পিপল , নো ফ্রেন্ডস।” কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ির দুলুনি তে ঘুম এসে যায়।  সিটবেল্ট বাঁধা শরীরটা গভীর ঘুমে ঢুলে পড়ে।  চোখ খুলতে আবার সেই বন্ধ ঘর।  

মাঝে মাঝে কমিউনিটিতে হাঁটতে নিয়ে গেলে , হঠাৎ করে চোখে পড়া মানুষের দিকে দৌড়ে যায়।  “হাই” বলতে চায়।  কিন্তু চেপে ধরে থাকি হাতটা , যদি ছুটে গিয়ে ছুঁয়ে দেয়। বুকের ভেতরটা ডুকরে কেঁদে ওঠে , কিন্ত কিছু করার নেই।  

আগে ছিল বাবা মার্ সাথে সপ্তাহান্তে বাজার করতে যাওয়া।  ওয়ালমার্টের আইলে আইলে বসে থাকা মেলার মধ্যে ছুটে বেড়ানো আর রেজিস্টার কাউন্টারের ওপরে লেখা নাম্বার গোনার খেলা।  এখন তার দোকানে যাওয়া বারণ।  এমনকি দোকান থেকে ফেরার পর বাবা মার কাছে যাওয়া বারণ।  জিনিসপত্রে হাত দেওয়া বারণ।  শুধু বারণ আর বারণ।  

স্ক্রীনটাইম নিয়ে এতো তোলপাড়ের পর, এখন সবাই নীরবে বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের ট্যাবলেট বা ফোন।  ঘাড় ঝুঁকে যাচ্ছে মিকি , মিনি , ডিজনি আর মোবাইল গেমের মধ্যে।  স্কুল থেকে পাঠানো হচ্ছে নানা এক্টিভিটির খবর।  কিন্তু বেশির ভাগ অনলাইন নয়তো বাবা মা কে সঙ্গে নিয়ে বসতে হচ্ছে।  আর বাবা মা অফিসের সাথে তাল মেলাতে খিঁচিয়ে যাচ্ছে।  আগে মাঝে মধ্যে ব্লাঙ্কেট জড়িয়ে বসে থাকা মুভি নাইট এখন আর হচ্ছে না। কারণ খালি সময়ে সবাই চেষ্টা করছে যাতে টিভি ইন্টারনেট ছাড়া অন্য যদি কিছু করা যায়।  

দরজার বাইরে ছুটে যাচ্ছে কাঠ্বেরালি , উড়ে যাচ্ছে পাখি , দৌড়ে বেড়াচ্ছে খরগোশের দল।  কিন্ত তার পেছনে ছোটার জন্য দরজা আর খুলছে না।  নরম ঘাস কচি পায়ে সুড়সুড়ি দেওয়ার বদলে এক নিশিডাকা হাতছানির মতো দুলে যাচ্ছে।  ফুটছে ড্যান্ডেলায়ন , সবুজ পাতা আসছে গাছে।  চেরি ব্লসম , আপেল ব্লসমে সাদা , হয়ে যাচ্ছে গাছগাছালি  কিন্তু ছোট্ট মানুষটা আর বিকশিত হচ্ছে না।  

স্কুল বন্ধ থাকবে এই পুরো স্কুল ইয়ারটা , মানে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।  ডে কেয়ারও খুলবে না।  খুললেও হয়তো আমরা পাঠাবো না।  একাকিত্বে কেটে যাবে একটা বড় সময়।  জীবন মানুষ একবারই পায়।  শৈশব , কৈশোর , যৌবন সবই মানুষ একবারই পায়।  একটার সাফল্যের ছাপ আরেক জীবনে এসে পরে।  জানিনা এই শিশুদের পরবর্তী জীবন কেমন হবে।  যুদ্ধের সময়ের বছরের পর বছর এই লকডাউনে বসে থাকা শিশুগুলোর ওপর পরবর্তীকালে এসেছিলো মানসিক বিকৃতি।  জানিনা , এরাও কোনো কিছুর শিকার হবে কি না।  

শেষ হোক এই বন্দী দশা এই কামনা করি।  

Sunday, April 12, 2020

#গো_করোনা_গো ( ১৬) - করোনায় কেশ ও না

 
 
ঘর থেকে বেরোবিনা।  এক্কেবারে বেরোবিনা।  সবার থেকে দূরে দূরে থাকবি।  ছ ফুট দূরত্বে।  এহঃ , প্রেম। ওসব দেখা টেখা , চুমু টুমু সব মুলতুবি, মাস্ক পরে কি আর চুমু হয়।  ভেবে নে , এক বছরের অশৌচ।  ওই দোকানদারের প্রেমে পড়েছিস নাকি।  সারা পৃথিবীতে লোক মরছে , আর তুই পঞ্চব্যঞ্জনের জন্য হেদিয়ে পড়ছিস।  দু দিন ডাল ভাত খেয়ে থাক।  টাটকা সবজি টবজি না খেলেই নয়।  বেশি সবজি খেলে হাগা হয়।  ডাল ভাত খা।  স্টোর করে রাখ।  যেখানে যা পাচ্ছিস নিংড়ে খা।  অতো নন ভেজ খাবার কি আছে। নিউট্রেলা খা।  

কিন্তু মাসি তখন থেকে শুধু খাবার আর প্রেমের কথা বলে চলেছো। আমি বলছি চুলের কথা।  মানুষের সংস্পর্শে যাবো না, তার হাজার পন্থা আছে।  কিন্ত নিজের চুল নিজে কাটি কি করে।   

মাস খানেক গৃহবন্দীর পর এই প্রশ্নে অখণ্ড নীরবতা পালন।  

অঙ্ক কষে দেখেছি , কদমফুল থেকে পাখির বাসা হতে আমার পাক্কা তেত্রিশ দিন লাগে।  যেদিন থেকে ঘরে খিল মেরেছি তবে থেকে এই চিন্তা মাথার মধ্যে উকুনের মতো ঘুরে চলেছে।  নিজ প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিয়ে নিজেই পিঠ চাপড়ালাম , “দাড়ি কাটার ট্রিমার চালিয়ে উড়িয়ে দিই।” 

একেতেই বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে মাথা গরম হয়ে আছে।  চুল বাড়লে আরো গরম হবে। হতে হতে না হওয়া ডিভোর্স হয়তো আজই হয়ে যাবে। আর সবথেকে বাজে ব্যাপার আমার চুলে কিছুতেই স্টাইল নামক কিছু করা যায়না।  লোকে এই সুযোগে নানা স্টাইলের চুল বাড়িয়ে ফেলবে।  কিন্ত আমার শুয়োরের কুঁচির মতো চুলে গুটলি পাকানো ছাড়া কিছুই হবে না।  শুধু সুন্দরীরা যখন চুল কাটে তখন কমপ্লিমেন্ট দেয় , যে এই টেকোদের নরকে আমি শক্ত চুলের ইন্দ্র।  কিন্তু তারা তো জানে না , সেলুন থেকে বেরিয়ে কানে ফুরফুরে হাওয়া লাগিয়ে গুনগুনিয়ে গান গাই , “মুক্তির মন্দির সোপান তলে , কত চুল হলো বলিদান।”  

তাই সেই মুক্তির স্বাদ , এই ট্রিমারই দিতে পারে।  ভুরু বাদ দিয়ে সব উড়িয়ে দিই। এক্কেবারে ন্যাড়া।  সেই কোন কালে শেষ  ন্যাড়া হয়েছিলাম পৈতের সময়। সে সময় মশারিতে টাক আটকে যাওয়া ছাড়া সমস্যা কিছু ছিল না। এখন তো আরো আরাম। আমার মাথাটা বেশ বড় , মানে বিশাল , মানে সবথেকে বড় সাইজের হেলমেট বেশ টাইট হয়, সেইরকম বিশাল।  চুলে কাঁচি চালালে কট কট করে আওয়াজ হয়। এই চুল রেখে কি হবে।  যা ইস্টাইল দেয়না , কালবৈশাখীতেও ওড়ে না , কাটার পর দাঁড়িয়ে থাকে , এরকম বেয়াদপ চুলের জন্য সুন্দরীর নিস্বাসের করোনা খাবো কোনো দুঃখে। উড়িয়েই দেব শালা। ট্রিমারে ছেঁটে , রেজারে চেঁচে , ঘাম তেলে লেপটে হালকা হয়ে যাবো।  না হয় একটা কোলাব্যাঙের মতো দেখতে লাগবে কিন্তু আমায় আর কে দেখবে।    

ওদিকে যাকে দেখবে , সেই আমার পুত্র সন্তানের জিনবাহিত রোগ হিসেবে টুপি চুলের বিস্তারে তারও ভয়ানক অবস্থা।  ওনাদের চুল কাটার দোকান আবার আলাদা।  ওই চেয়ারের ওপর একটা পাটাতন রেখে উঠে বসে বাটি বসিয়ে কেটে দিলে চলবে না।  এনার ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো দোকানে চুল কাটার থেকে স্বপ্ন দেখানো বেশি হয়।  আর ছেলের চুল যে কাটে, সে reese witherspoon কে কপি করে।  তাই এ সব ছেড়ে তারও বেশ সমস্যা। হাজার হোক , “মেন উইল বি মেন।” সে এই কসাই বাবার কাছে চুল কাটবে কেন।  অথচ বাবার বিদ্যার দৌড় সেই কোদালেই।  

এই সমস্ত চিন্তা ভাবনা করতে করতে বাড়িতে ফোন করতেই , “কি শুনছি রে ? আমরা বেঁচে থাকতে ন্যাড়া করবি কি ? ” মানে বিভীষণ খবর পাঠিয়ে দিয়েছে। তারপর বাকিটা আর এগোলো না।  আপাতত মিঠুন চক্কোত্তি হতে চলেছি,ভুঁরি নিয়ে ডিস্কো ডান্সার তো হতে পারবো না।  তার বদলে ঘাড়ের চুল দুলিয়ে বলবো , “ ইয়ায়িশ। … সাপের ছোবল আর চিতার খাবল , যেখানেই পরবে , আড়াই কেজি মাংস তুলে নেবে।” ইয়ে, মানে,  তখনও  করোনা দা ছিলেন না আর কি।     

Monday, April 6, 2020

#গো_করোনা_গো ( ১৫) - বাজার থেকে ফিরে


 
বাড়িতে বলতেই খিঁচিয়ে উঠলো , “বাজারে যাবার নাম করলেই রোজ জ্ঞান দিচ্ছিস, আর আজকে তুই কি করছিস?” একদম হক কথা। লকডাউনের পর থেকে খেঁচিয়ে চলেছি বাবা মার ওপর, কিন্তু আজ আমাকেই বেরোতে হলো দুধ নেওয়ার জন্য।  কিছুদিন আগে পর্যন্ত ধ্বস্তাধ্বস্তি করে বেশ কিছু খাবার জোগাড় করে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছি।  কিন্তু কিছু জিনিস আনতে যে যেতেই হচ্ছে।  

কেন ? অনলাইন অর্ডার করলে হয় না।  অবশ্যই হয়।  পৃথিবীর বহু লোক তো তাই করছে।  কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক ততটা অনুকূল নয় আমার এই শহরে।  সেই বলতেই এই লেখা।  

আমি যে শহরে থাকি , সেটি একেবারেই রেসিডেন্সিয়াল। নাম করা দোকান বলতে কিছুই নেই।  যা আছে, তা ঠিক পাশের শহরে। যা দূরে না হলেও সফটওয়্যারে কিন্তু জিপকোড যা সেট করা থাকে তাই দিয়েই ডেলিভারি বিচার হয়।  তাই আমার বাড়িতে ডোমিনোসও আর ডেলিভারি করে না।  

আমেরিকায় হোম ডেলিভারি কোনোদিনই দেশের মতো দারুন ভালো ছিল না।  তার কারণ , আর কিছুই নয় , অতিরিক্ত লেবার চার্জ , যার জন্য আমরাও এদেশে পরে আছি।  এখন এই কঠিন সময়ে সবাই আমরা উদার হয়ে হাতে পয়সা নিয়ে যদিও বসে আছি ডেলিভারির জন্য কিন্তু সময় বদলালে আমরাও হাত গুটিয়ে নেবো।  এখন তাই আমাদের সার্ভ করতে ডেলিভারি বয় গার্ল দের নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে যাচ্ছে , এদের আবার ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে সময় যখন বদলাবে।    

এখন আছে প্রাণের ভয়।  শুধু নিজের নয়, একবার ভাবুন তো এই মানুষ গুলোর কথা।  তারা আজ পেটের দায়ে এই ভয়াবহ সময়ে রোজ কাজে বেরোচ্ছে।  আর জানা না জানা দোকান থেকে জিনিস তুলে বাড়িতে বাড়িতে ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছে।  সবাই নিজের দরজায় এখানে “Thank You”  লিখে রাখছে শুধু এই লোক গুলোর জন্য।  

এখন সমস্যা হলো সাধারণ ভাবে অর্ডার ডেলিভারি করার জন্য যে পরিকাঠামো থাকে বা আছে ,  সেটা প্রচন্ড ডিমান্ডের চাপে প্রায় ভেঙে পড়েছে।  এমনিতেই আমেরিকা ভিড় সামলাতে একেবারেই পটু নয়।  তবু পিজা অন্তত আগে তাড়াতাড়ি ডেলিভারি হতো ।  কিন্তু এখন সেটাও প্রচুর সময় লাগাচ্ছে।   

ওয়ালমার্টে খুব সুন্দর গ্রসারি পিকাপ এর ব্যবস্থা আছে।  অ্যাপ থেকে অর্ডার করে দিন , কর্মচারীরা পিকআপ করে গাড়িতে এসে তুলে দিয়ে যাবে।  কিন্তু এই পিকাপের জন্য সারাদিনের একটা নির্দিষ্ট শ্লট আছে।  মানে নটা পাঁচ থেকে নটা পনেরো আপনার টাইম, যা আপনি বুক করেছেন।  কিন্ত সারাদিনের সমস্ত স্লট প্রত্যেকদিন ভরে যাচ্ছে। আমি দিনের পর দি চেক করে করেও স্লট পাচ্ছি না।  

ইন্সটাকার্ট বলে একটা ওয়েবসাইট আছে , যা সাতদিন পরে ডেলিভারি দিচ্ছে এবং ওয়ালমার্টের দুদিনের বদলে সাত দিনের শ্লট দেখাচ্ছে।  কিন্তু আমার জিনিসপত্র প্রায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না ইনস্টকার্ট এ।    

আমরা তো যা কিছু খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবো কিন্তু ছেলেটা ছোট।  তাই দুধ ডিম আর কিছু সবজি তো লাগবেই।  দুধ ডিম নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতে জানতে পারলাম মিল্কম্যান বলে একটা লোকাল ডেয়ারী দুধ, ডিম্, পাউরুটি , বাটার আর চিস ডেলিভারি করছে।  অতি উত্তম , ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠে দাম দেখে বুঝতে পারলাম সবার জন্য সব কিছু না।  আমি যেখানে থাকি সেখানে,  এদিক ওদিক থেকে টেসলা টুকি টুকি খেলে।  এ তাদের জন্য, আমার জন্য নয়।  

পেলাম পি-পড বলে স্টপ এন্ড শপ বলে একটা গ্রোসারি স্টোরের ডেলিভারি সিস্টেমের খোঁজ।  সেখানেও ডেলিভারির সেই লম্বা লাইন।  এই এতো তুলকালাম , তার একটাই কারণ আমাজন ফ্রেশ বা আমাজন প্যান্ট্রি আমার শহরে ডেলিভারি করে না।  

অগত্যা , মাথায় পালকের টুপি , হাতে বল্লম , চোখে ভয় , আর যুদ্ধের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে সেইটা হাতের মুঠোয় ধরে এক্সিলারেটরে চাপ দিলাম।  মাস্ক তো এতদিন হলো কিনতে পারিনি।  তাই দেশের স্টাইলে রুমাল মুখে বাঁধতে গিয়ে দেখি বড় রুমাল নেই।  এখানে যেহেতু ধুলো নেই , তাই রুমাল রাখার অভ্যাস ও নেই।  দেশে কিনেছিলাম দু চারটে রুমাল , সেটাই স্যুটকেস থেকে বার করে নিয়ে দেখি এই কেস।  তারপর আর কি , “সেফটিপিন জিন্দাবাদ”।  মুখই দেখা যাবে না তো মাথার পেছনে সেফটিপিন গোঁজা দেখে মুচকি মেরে হাসা লোকেদের কটাক্ষে লজ্জিত হওয়ার কিচ্ছু নেই।  

গাড়িটা দাঁড় করিয়ে মুখোশটা ভালো ভাবে পড়লাম।  তারপর হাতে বাসন ধোয়ার ভিনাইল গ্লাভস পড়লাম। সেখানেও চিত্তির , এই গোদা হাতে কি আর গিন্নির মিডিয়াম গ্লাভস ঢোকে, লার্জ পাইনি।  স্পাইডারম্যানের কষ্ট সেদিন বুঝতে পারলাম।  কানে ইয়ারফোন আগেই গুঁজে দিয়েছি যাতে যদি ফোন আসে তাহলে কষ্ট করে ফোন তুলতে হবে না।  

সেই রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে যেই শপিং কার্টে হাত দিলাম , প্রচন্ড ভয় এসে চেপে ধরলো।  নিঃস্বাশ- প্রস্বাস দ্রুত হতে লাগলো।  এক অসহায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোকানের ভেতরে ঢুকলাম।  মনে হলো এই মাত্র পুলিশে ক্যাদানে গ্যাস ছেড়ে গেছে। সবাই আমার থেকেও অভিনব মাস্ক লাগিয়ে ঘুরছে।  যারা লাগায়নি , তাদের হাতে অন্তত গ্লাভস, সেও নানা তার রূপ।  

একটা জিনিস দেখে কষ্ট লাগলো , এই অসময়ে বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ বাজার করতে এসেছেন।  এই ভাইরাসের সবথেকে বড় টার্গেট এরাই।  কিন্তু আজ তাদের বেরোতে হয়েছে যেহেতু কেউ নেই তাদের কাছে।  কেউ নেই তাদের জন্য বাজার করে দেওয়ার। আমার বাবা মাও ঠিক এইরকম করে বাজার করছে।  

সোশ্যাল ডিস্টেন্স বজায় রাখার জন্য খুব সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়েছে।  দরজা দিয়ে ঢুকে একটা এক মুখী তীর আঁকা আছে মেঝের ওপর।  সেটা ফলো করে চললেই সমস্ত আইল ঘুরে ঠিক চলে আসবেন ক্যাশ রেজিস্টারের কাছে। তাহলে সবাই সবার থেকে অন্তত বেশ কিছুটা ব্যবধান রাখতে পারেন।  কিন্ত আমার মতো বেশ কিছু লোক সারা দোকানে ঘোরার মুড নিয়ে আসেনি।  তারা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে।  পকাপক জিনিস তুলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে তারা মুখিয়ে আছে।  

কি মনে হলো আমি ওদের দল থেকে বেরিয়ে ওই লাইন ধরে পর পর আইলগুলো দিয়ে ঘুরতে লাগলাম।  লোকে বেশ কিছুটা ব্যবধান রাখছে। স্যানিটাইজার নেই , হ্যান্ডওয়াশ খালি , ডিসিনফেক্টিভ ক্লিনার শেষ , ওয়াইপ শেষ , ফ্রোজেন ভেজিটেবল শেষ , চিকেন শেষ আর যা যা চাইছিলাম তার বেশির ভাগই শেষ।  বেশিদিন চলে বলে টাটকা সবজির মধ্যে ফুলকপি , বাঁধাকপি ,  স্কোয়াশ , কুমড়ো , আলু , শালগম , গাজর , বিট সব শেষ।  দুধ ডিম আর কিছু সবুজ ভেজিটেবল তুলে নিলাম।  মনে পড়লো গিন্নি মেসেজ করেছে লিস্ট।  কিন্ত এখন সেই মেসেজ খুলতে আমাকে খুলতে হবে গ্লাভস।  যা কিছুতেই সম্ভব নয়। 

দোকান থেকে বেরোতে চিন্তা এলো এবার গ্লাভস খুলে কি স্টিয়ারিংয়ে হাত দেব ? না গ্লাভস পরে।  গ্লাভস খুলে গাড়িতে বসলে স্টিয়ারিংয়ে হয়তো করোনা লাগবে না।  কিন্ত যখন জিনিসগুলো নামাবো তখন তো হাতে লেগে যাবে। আর যদি গ্লাভস পরি , তাহলে স্টিয়ারিংয়ে লেগে যাবে।  তাহলে প্লাস্টিকের ওপর টিকে থাকা করোনা , তিন দিন পর্যন্ত গাড়ির মধ্যে ঘুরঘুর ঘুরঘুর করবে।  আর আমার নাক থেকে এক হাতের মধ্যেই ঘুরে বেড়াবে।  কিন্ত যদি খুলে রাখি তাহলে বাড়ি গিয়ে আবার পরে কিনেআনা জিনিস বাড়িতে রাখতে রাখতে ভুল করে একবার নাকে হাত দিলেই সব শেষ।  অনেক কিছু চিন্তা করে , প্রায় দম বন্ধ করে দোকান থেকে বাড়ি ফিরলাম গ্লাভস পরেই।  

যে জিনিস খারাপ হবে না , সেই জিনিস গুলো পরে থাকলো গ্যারেজে, পরের তিন দিনের জন্য।  আর বাকি সমস্ত জিনিসকে ডিসিনফেক্টিভ দিয়ে পুঁছে এক এক করে তুলে রাখা হলো ঘরে।  সে দুধ হোক কি সবজি এখন সব কিছুতেই ব্লিচিং এর গন্ধ। যখন বাইরের জামা কাপড় বাইরে ছেড়ে গরম জলের তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে।  

ওই তিন গ্যালন দুধ শেষ হতে আর ৯ দিন।  

Thursday, April 2, 2020

#গো_করোনা_গো ( ১৪ ) - 1 million in world 250K in US




worldometer এর পেজ রিফ্রেশ করতে পৃথিবীর নাম্বারে  ৭টা সংখ্যা দেখালো।  ওদিকে আমেরিকা আড়াই লক্ষ ছুঁই ছুঁই।  এদিকে জীবনে এসে গেছে “আর ভালো লাগছে না।” বিরক্তিতে মুখ পাঁচের মতো করে দিবারাত্রি অফিসের কাজ করে চলেছি আর খবরে পরে চলেছি সারা পৃথিবীর অতিসামাজিক কার্যকলাপের কথা।  

মানুষ এখনো সেই প্লেগের গল্পের মতো কথা বলে চলেছে।  “আমার হবে না”। সবাই তাই ভেবেছিলো।  আমেরিকাতে শুরু হয়েছিল এমন এক রাজ্যে , যেখানে শুধু বড় বড় জঙ্গল আর স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। টুইলাইটের ভ্যাম্পায়ারই বেঁচে থাকে ওই রাজ্যে। কেউ তাই বিশেষ পাত্তাই দেয়নি।  এরপর স্বাভাবিক কারণে নিউ ইয়র্ক আর ক্যালিফোর্নিয়া , আমেরিকার সবথেকে বড় দুই বহির্জগতের গন্তব্য যখন সংক্রমিত হতে লাগলো।  তখনও শুধু নিজের রাজ্য ছাড়া মানুষ কিছু দেখেনি।  আর ঘুরতে বেরিয়েছে।  মিশিগান, ওহাইয়ো আর ইলিয়নয় যাকে এক সাথে মিড্-ওয়েস্ট বলা হয় সেখানে থাকা বন্ধু বান্ধবদের বলতে শুনেছি , “এখান পর্যন্ত আসবে না।” এখন প্রত্যেক দিন তারা এগিয়ে চলেছে।  কম্পিটিশন চলছে কে কত সংক্রমিত লোকের নাম দেবে , আর কে কত মৃত্যু ঘোষণা করবে।  কিন্তু মানুষ এখনো বলে চলেছে , “আমার কাউন্টি বা আমার শহরে তো হয়নি।  চিন্তা কম।” ধীরে ধীরে সবার হবে।  

আমেরিকা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বেশি করোনা টেস্ট সম্পন্ন করেছে আজ পর্যন্ত, অন্তত এই নম্বর এখনো কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি।  কিন্তু আজ ডাক্তার বার্কস বললেন যে ১৩ লক্ষ টেস্ট করানোর পর শুধু ৬.৬ লক্ষ টেস্ট রেজাল্ট তার কাছে এসেছে।  মানে এখনো ছবিটা বাকি আছে।  যত টেস্ট করা হবে তত মৃত্যু সামনে আসবে।  

সামনে আসবে সেই মানুষগুলোর কথা যারা এই নিদারুন সময়ে তাদের জীবনের তোয়াক্কা না করে মানুষকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে।  একবার কোনোদিন ডাক্তারদের পিপিই বা পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন , সাধারণ মুম্বাইয়ের বৃষ্টি পর্যন্ত ওই দিয়ে আটকানো সম্ভব নয়। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত খবর আসছে নির্দোষ ডাক্তারদের মৃত্যুর খবর।  সেই ছবিটা দেখে বুক কেঁপে উঠেছিল যখন চায়নার নানা প্রান্ত থেকে ডাক্তার রা হুয়ান প্রদেশে যাচ্ছিলো , আর তাদের পরিবাররা শেষ বিদায় দেওয়ার মতো কাঁদছিলো।  এখন সেই ছবি চারপাশে , আসে পাশে।  

আর এর মধ্যেই “নেপো”র উপদ্রব শুরু হয়েছে।  ড্রাগ মাফিয়ারা এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে চোরাচালানে দ্রুতি এনেছে , ভ্যান গগের ছবি চুরি হয়েছে , আর নিউ ইয়র্কের ক্রাইম বেড়ে গেছে ১২ শতাংশ।  পুলিশ সারা পৃথিবী জুড়ে নানা ভাবে ক্রিমিনাল দের কার্যকলাপ থামাতে বলছে।  ক্রাইম রেট কমছে অনেক জায়গায়।  কিন্তু তাও ছয়লাপ।  দু ট্রিলিয়ন ডলার থেকে নেপোরা কতটা পাবে সেটা যেমন দেখার মতো , তেমনি ভারতের বুকে এর পরবর্তী যুগে বেরোবে করোনা স্ক্যাম।  এই কোটি কোটি ডলারের গভর্নমেন্ট পয়সা উজাড় করলে কেউ যে হাত সাফ করবে না সে তো আর হয়না।  ঠিক যেমন অনেকেই আমেরিকায় এখন আনএমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট নেওয়ার জন্য হাত পেতেছে।  

খবর আসছে বড় বড় কোম্পানির লে অফের।  তুর্কিশ এয়ারলাইন্স ৯০% ছাঁটাই , ডিজনি বেশির ভাগ কর্মচারীকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে , ব্রিটিশ এয়ারলাইন্স আঠাশ হাজার লোক বার করে দিয়েছে এরকম খবর রোজ আসছে। অনেক কোম্পানি চেষ্টা করছে যাতে মাইনে কম দিয়ে চাকরি বাঁচিয়ে রাখানো যায়।  অনেকে ছুটি ব্যবহার করে নিতে বলছে।  কিন্তু কেউ জানেনা কি হতে চলেছে।  সেই গুমনাম এক শত্রু নানা দিক থেকে চেপে ধরছে গলা।  

এখনো দেশে এই আতঙ্ক ছড়ায়নি এতটা, তাই এখনো টিকটক চলছে।  সময় আসলে আর সময় থাকবে না আল্লাহ , রাম, যীশুর নাম নেওয়ার। কালকে আবার বাঁচতে চাই , নিউ ইয়র্কের ওই রাস্তার ধারে পরে থাকা মোবাইল মর্গে শুয়ে থাকতে চাইনা।  তাই কালকে উঠে আবার লিখবো।