unsung heroes - কথাটা এলে এদের নাম কেউ নেয় না। কারণ এরা প্রাণ বাঁচায় না। জীবন বাঁচায়। করোনার প্রকোপে গৃহবন্দী কোটি কোটি মানুষ এই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমে না। বরঞ্চ তাদের কপালে জোটে গালাগালি। কারণ এদের নাম নেই। নেই এদের একক প্রচেষ্টার কোনো মূল্য। এই গোষ্ঠী যা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে মনুষ্যত্ব লোপ পাওয়ার ভয়। সেই গোষ্ঠী যাদের কারণে মানুষ মানুষকে ভুলে যন্ত্রের দাস হয়ে গেছে। সেই টেকনোলজির মানুষগুলির গান কেউ গায় না।
করোনা মৃত্যুদূত। তাদের সাথে সাদা কালো যুদ্ধে লড়ছে ডাক্তার রা। আর টেকনোলজি লড়ছে তাদের জন্য যারা ঘরে বন্দী , অথচ মৃত বা আহত নয়। মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এখনো তারা মানুষ, এবং তারা মানুষই থাকবে।
মানুষ এখনো মারা যায়নি। মরতে দেয়নি এই প্রযুক্তিবিদ্যা। ঘরে বন্দী থেকে অনলাইনে চলছে অর্ডার। বাড়িতে আসছে খাবার। ধরে নিন সেই দিনগুলির কথা, যেদিন ইন্টারনেট নেই। নেই ফোন। আছে করোনা। আর আপনি গৃহবন্দী। বাইরে পুলিশের লাঠি , নয় মারণ ভাইরাসের কামড়। ভেবেছেন কখনো স্প্যানিশ ফ্লু তে লকডাউন না হয়ে ছাতারের মতো মানুষ কেন মরেছিল। শুধু টেকনোলজি ছিল না বলে।
বৃদ্ধ বাবা মা কে রেখে মোটে তিরিশ কিলোমিটার দূরে থাকা মানুষ গুলোর ছটফটানি থামছে ভিডিও চ্যাটে। পঞ্চেন্দ্রিয়র অন্তত দুটো ইন্দ্রিয়ের পরিতুষ্টির দায়িত্ব নিয়েছে এই টেকনোলজি। দুই দেশে আটকে পড়া মানুষগুলো বলছে , “মা , বেরিও না বাইরে। আমি অনলাইনে অর্ডার করে দিচ্ছি।”
ঘরে বন্দী থেকে কিচ্ছু করার নেই বলে আতিয়ে পড়া মানুষ আজ “বোকাবাক্স” নাম দেওয়া যন্ত্রের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। দেখছে সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা। মনে রাখছে সেও মানুষ। সরাসরি রাষ্ট্রনায়কদের কথা শুনছে। শুনছে বিশ্বব্যাপী তান্ডবের কথা। কখনো ভেবেছেন কি ভাবে এ সব সম্ভব।
কখনো ভেবেছেন ওয়্যারলেস কিন্তু আদপে তারে তারে সংসযোগ। আপনার জন্য কেউ টাওয়ারে চড়ছে শুধু এক এন্টেনা থেকে আরেক এন্টেনার পনেরো ডিগ্রি এঙ্গেল ম্যাপ রাখতে। ঝড় জলের শেষে পাওয়ার কাটে বিরক্ত হয়ে “ধুর শালা” র পর যখন কারেন্ট আসে তখন ইলেকট্রিক টাওয়ারে ওঠা ছেলেটার কথা কি কখনো মনে করেন। ঠিক সেরকম ভাবেই আজ ধন্যবাদ পায়না সেই মানুষগুলোর কথা যারা আজও প্রাণ হাতে করে রাউটার রুমে বসে আছে যাতে আপনার অর্ডার পৌঁছে যায় দোকানগুলোর কাছে। জানেন তো সেন্ট্রালাইজড এয়ার কন্ডিশনে করোনা তাড়াতাড়ি ছড়াচ্ছে।
দিব্যি লাগছে অনেকের ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বাস ট্রামে ধাক্কাধাক্কি নেই। নেই চ্যাঁচামেচি চিৎকার। আছে শুধু ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট। হয়ে যাচ্ছে কাজ। বাড়িতে বসেই জগৎ কাঁপাচ্ছে মানুষ। কনফারেন্স কলে বাড়ি দেখা যাচ্ছে বলে হা হুতাশ করছেন। আর প্রাইভেসি চলে যাচ্ছে বলে বাপ বাপান্ত করছেন। তাদের বলে রাখি , যেহেতু আপনি আপনার ডেটা শেয়ার করছেন তাই কোম্পানি আপনাকে এলাউ করছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করার। নাহলে আপনি ডেটা বিক্রি করতে পারতেন যে কোনো ভাবে। যা যেকোনো কোম্পানির কাম্য নয়।
এই টেকনোলজি জায়েন্টরা এই সমস্যার দিনে ফুলে ফেঁপে উঠছে বলে সবার লালামিশ্রিত ঘেন্না বাড়ছে বড়লোকদের প্রতি। কিন্তু শুধু এই কোম্পানিগুলো কোনো না কোনো সময়ে জল কাদা বৃষ্টির কষ্ট ত্যাগ করে সমুদ্রের তলায় , পাহাড়ের ওপরে , মাটির নিচে বিশাল বড় বড় ডেটা সেন্টার বানিয়েছিলো বলে আজকে আমি আপনি ঘর নামক জেলে বন্দি হয়ে পেনের শিস চোখে ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করছি না , বরঞ্চ নেটফ্লিক্স এন্ড ছিল করছি।
মাসের পর মাস বন্ধ থাকা স্কুল খুলে যাচ্ছে অনলাইন এডুকেশনে। প্রাইভেট টিউটর রা ক্লাস নিচ্ছে ভিডিও চ্যাটে। হোম ওয়ার্ক আসছে পিডিএফ এ আর প্রিন্ট করে সেটাই হচ্ছে ক্লাস। আপনার আমার বাড়ি কখনো হয়ে যাচ্ছে স্কুল , কখনো কলেজ , কখনো অফিস কখনো দোকান। হ্যাঁ হ্যাঁ দোকান ও। সেলাই মেশিন নিয়ে মাস্ক বানিয়ে বিক্রি কি আগে করতে পারতেন। ফেসবুকে টুক করে এড বানিয়ে হাজার হাজার ডেলিভারির অর্ডার কি কখনো আগে পেতেন। ঘরে বসে ফ্রি টাইমে বানানো আর্ট এখন লোকে বিক্রিও করছে। আর ইন্টারনেট কে গালাগালিও। দিচ্ছে, তাদের প্রাইভেসি শেষ করে দেওয়ার জন্য।
সব কথার শেষ কথা, এই পুরো দক্ষযজ্ঞে ইন্টারনেট বা কম্পিউটার সম্পর্কিত তথ্যপ্রযুক্তির কোনো কালো হাত নেই। অথচ সবথেকে বেশি অর্থনৈতিক ডোনেশন তাদের হাত দিয়েই পেয়েছে পৃথিবী। পয়সা দিয়ে , সার্ভিস দিয়ে , শান্তি দিয়ে মানুষকে মানুষ করে রেখেছে এই তথ্য প্রযুক্তি । শুধু এই ইনফ্রাস্ট্রাকচার বাঁচিয়ে রাখতে, এই পরিষেবা দিতে , বেশ কিছু মানুষ প্রাণ দিয়েছে , শুধু অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে। এই ছোট্ট সময়ে , এতো বড় দক্ষ যজ্ঞ সম্পন্ন করতে আহুতি দেওয়া হয়েছে। নাঃ তারা পি পি ই পায়নি।
থাক, আর বললাম না। নিয়মমতো , “হোয়াটস ইন ইট ফর মি।” আমার বেঁচে থাকার জন্য আজ এদের অবদান আমি অন্তত অস্বীকার করতে পারবো না। তাই বলি ,
“এই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি ,
যারা জীর্ণ মলিন মুখে জাগালো ভাষা ,
জীর্ণ জাতির প্রাণে জাগালো আশা। …… ”