Wednesday, November 15, 2017

৩৭) আধ্যানের ডায়েরী - আমি ও আইফোন


সেই কবে থেকে বাবার ঘ্যান ঘ্যান শুনে যাচ্ছি।  বাবার ফোনে নাকি আমি কবে মুতে দিয়েছিলাম তার জন্য ফোনের বারোটা গেছে বেজে।  আর যেহেতু সেটা আইফোন তাই নাকি সময়ের আগে কেনার সাধ্য নেই।  পরের আপডেটে নাকি বাবা নতুন ফোন কিনবে।  মা যেহেতু বাবার এই কথাটার ওপর কোনো আপত্তি করেনা, তারমানে সত্যি আমি ওই ঘটনাটা ঘটিয়েছিলাম।  কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো লোকে আমাকে অবুঝ বলে তবে বাবার এই কাজটা কি খুব বুঝমানের?  বাবার কি উচিত ছিল না ফোনটা আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।  যত দোষ নন্দ ঘোষ।  এই দোষ দেওয়াটা আমার পরিবারের এক কমন ডিসিস।  যে পারে , যখন পারে , যাকে পারে দোষ গিফট করে।  

আমার জন্য নাকি বাবা মা দুজনারই সোশ্যাল প্রেসেন্স কমে যাচ্ছে।  সমাজে থাকতে হলে নাকি এখন ফোনের দিকে ঘাড় গুঁজে তাকিয়ে থাকতে হবে।  আমার কি সোশ্যাল প্রেসেনসের দরকার নেই।  সব চন্দন কি গোপালের গায়েই লাগবে।  আমি যখন ফোন ধরি তখন খপ করে কেড়ে নেয়।  কেড়ে নেওয়ার বহর দেখলে গা জ্বলে যায়।  যেন আমি চুরি করেছি।  নিজেরাই যেখানে সেখানে ফেলে রাখবে।  আমার কি ইচ্ছা করেনা ওটা নিয়ে গাড়ি গাড়ি খেলতে।  

আমার যদিও অনেক গাড়ি আছে।  কিন্তু আইফোন গাড়িটা সবথেকে বেস্ট।  ধরতে সুবিধা , আর যেকোনো জায়গায় চলে।  মাঝে মাঝে টুংটাং শব্দ হয়।  আর বাবা যখন ধরে থাকে তখন তো ওর মধ্যে থেকে কত ধরণের শব্দ হয়।  গান বাজনা আর আমার কার্টুন।  মাঝে মাঝে ঠাম্মা দিদা ঢুকে পরে উঁকি মেরে টুকি টুকি খেলে ।  কত কথা বলি ওদের সাথে।  ওরা কত আবোলতাবোল বকে।  ওটা যেন স্বর্গরাজ্য। স্বর্গ মানে যদিও জানিনা। বাবার ডায়ালগ ছেপে দিলাম।  বাবার কাছে আইফোন আবার সেকন্ড বেস্ট ইনভেস্টমেন্ট। তা বটে।  কত কিছু কাজ করা যায়।  আগে কি করত জানিনা।  তবে আমার গাড়ি হিসেবে বেস্ট। 

আর যখন বাবা ফোন করে , ওই যে একটা গোল লাল ফুটে ওঠে না সেটা যে আমাকে কি টানে ।  নেশা লেগে যায়।  যেই ঠাম্মা বা দিদার সাথে কথা বলি আমার চোখ চলে যায় ওই ছোট্ট লাল গোলের দিকে।  ওটাতে হাত দিলেই যারাই ফোনের মধ্যে ঢুকে বসে থাকে তারা উধাও হয়ে যায়।  আর বাবা মা দুজনেই “এই - এই “ করে তেড়ে আসে।  আমার কি সবসময় হ্যাল হ্যাল করে কথা বলতে ভালো লাগে।  যখন ওরা আমার সাথে কথা বলে তখন আমিও ঢুকে যাই ফোনের ভেতর।  ছোট্ট হয়ে নিচে উঁকি মারতে থাকি।  আমি এখানে যা যা করি ওখানেও আমি তা তা করতে থাকি।যখন কথা বলতে ইচ্ছা করে তখন আমি আমার ওপর কন্সান্ট্রেট করি।   কিন্তু যখন ইচ্ছা করে না তখন শুধু লাল গোলই আমার টার্গেট।  

সেদিনকে দেখে হাঁ হয়ে গেছি।  আমি টিভিতে।  এ কি করে হলো।  দেখি আমি যা যা করছি।  টিভির ভেতর থেকেও আমি ঠিক তাই তাই করে চলেছি। পিছন ফিরে দেখি বাবা হাতে ফোন নিয়ে বসে আছে।  তাক করে আছে আমার দিকে।  যেন ছবি তুলছে।  ও হ্যাঁ ফোনে ছবিও তোলা যায়।  আর আমি যা যা করছি সেটাও তুলে রেখে দেওয়া যায়।  কি জ্বালাতন বলোতো ।  বাবার আবার সব নোংরা নোংরা সময়গুলো ফোনের মধ্যে তুলে রাখে।  আমি পরে সেগুলো দেখে হাসি বটে তবে অন্য কারো সামনে খুললে নেহাতই প্রেস্টিজে লাগে।  কিন্তু বাবা তো বাবা।  কিন্তু এ তো তখনি তখনি হচ্ছে।  বাথরুমের আয়নার মতো।  যা করছি তাই হচ্ছে।  বেশ কিছুক্ষন বোঝার চেষ্টা করে ছেড়ে দিলাম।  ফোনে মনে হয় ওটাও করা যায়।  

আবার ফোন ছুঁড়ে ফেললে বেশ মজা লাগে।  আমার সব খেলনা গুলো হয় খুব হালকা নয় খুব ভারী।  কিন্তু ফোনটা একদম এপ্রোপ্রিয়েট।  হাতে নাও , যেখানে কার্পেট নেই সেখানে গিয়ে ছুঁড়ে দাও।  কি সুন্দর ফটাক করে আওয়াজ হয়।  যদিও আমি বেশিবার করতে পারিনি।  তবে সুযোগ পেলেই করবো। যদিও অজান্তে মুতে দেওয়ার জন্য বাবার ফোন খারাপ হয়ে গেছিলো, কিন্তু আমার সবথেকে ভালো লাগে ফোনের ওপর আমার সিপি কাপ থেকে জল ফেলতে।  সিপি কাপে তো এমনি কিছু বেরোয় না।  কিন্তু মুখটা ফোনের ওপর ঘষে দিতেই গোল একটা জলের বল বেরিয়ে ফোনের ওপর বসে থাকে।  হাত দিয়ে ঘষে দিলে ছেৎরে বেৎরে যায়।  কি মজাই না লাগে।  জলের জায়গায় দুধ ফেললে আরো ভালো লাগে।  কিন্তু কোনোটারই বেশি চান্স পাওয়া যায় না।  সুযোগ পেলেই করি।  

যখন আমরা ঘুরতে যাই, মায়ের চিরকালীন বদভ্যাস ঠান্ডা খিচুড়ি নিয়ে যাওয়া।  খিদে না পেলেও গাড়িতে বসে কোঁৎ কোঁৎ করে গেলাবে।  আমি প্রথমে একদম বিদ্রোহ করতাম।  কিন্তু বাবা যবে থেকে ফোনেই টিভি লাগিয়ে দিয়েছে তবে থেকে খাবার নৃশংসতার থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখার সুযোগ পেয়েছি।  চলতি গাড়িতে অত্যাচারী মায়ের পাশে বসে যন্ত্রনা সহ্য করার একমাত্র ভরসা আমার চু চু টিভি।  আর সেটা যখন ফোনেও থাকে তখন আমিও মানি যে এটা বাবার সেকন্ড বেস্ট ইনভেস্টমেন্ট।  

ফোন যখন চলে তখনই ওর সবথেকে বেশি এট্ট্রাকশন।  বাবা মার্ দুজনার ঘাড় যায় পুরো বেঁকে।  কিন্তু আমার এট্ট্রাকশন কোনো অবস্থাতেই কম হয়না।  হোক সে চালু, হোক সে বন্ধ।  ফোনের নিচে যে গোল কালো বাটন আছে সেটাই আমায় সবথেকে বেশি আকর্ষণ করে।  কি সুন্দর খেলনা।  আঙ্গুল দিয়ে চিপলে দেবে যায়।  আবার উঠে আসে। আর সাথে থেকে থেকে আলো  জ্বলে ওঠে, আবার বন্ধ হয়ে যায়।  টিপে ধরে রাখলে আবার কে যেন কথা বলে ওঠে।  মাও পাস থেকে বলে ওঠে , “ওই দেখো আবার সিরি অন করে দিয়েছে ” ওদিকে ফোন থেকে বলে ওঠে , “আই কুডণ্ট হিয়ার ইউ প্রপারলি” আর মা এসে ফোন তুলে নেয়।  

কিন্তু ওই বাটন আমার স্বপ্নচারিনী। ফোনটা কোনোরকমে হাতে পেলেই ওই বাটন টেপার ঘোর চেপে বসে আমার মাথায়।  কেউ লক্ষ্য না করলে টিপেই যাই , টিপেই যাই।  ফোনে কত কিছু হতে থাকে।  এক সময় ফোনের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গিয়ে ওপরে কিছু একটা লেখা চলে আসে আর বাবা চ্যাঁচায় , “ওই দেখো আবার ডিসএবল করে দিয়েছে . ” বলে বটে ডিসেবল, কিন্তু কিছুক্ষন পরেই আবার এবল হয়ে ওঠে আমার সাধের আইফোন।  

বেশ কিছুদিন ধরে দেখছিলাম বাবা আমার বাবা আমার ব্যবহারে অত্যন্ত বিরক্ত।  মাঝে মাঝেই মা কে বলছে, “না এই বাটন বন্ধ করতেই হবে।” কেন বাপু , সব কিছুতেই তো লক লাগিয়েছো।  কিছুই তো খুলতে পারিনা।  এই একটা জিনিস দুর্ভেদ্য কিন্তু অভেদ্য নয়।  এখনো আমি মাঝে মাঝেই হাতে পেয়ে যাই।  এই সুখ থেকেও আমাকে বঞ্চিত করার ঠিক কি মানে আছে। কিন্তু বাবা হলে মনে হয় দুটো শিং বেরোয় আর আমার দাঁতের মতো সুর সুর করে।  সবসময় গোঁতাতে ইচ্ছা করে।  সেদিন কি একটা দেখে নাচতে নাচতে মায়ের কাছে গিয়ে বললো , “শেষমেশ আপেল ও বুঝেছে যে আধ্যানকে ওই বাটন থেকে দূরে না রাখলে ব্যবসা উঠে যাবে . ” আপেলের সাথে ফোনের কি সম্পর্ক সেটা বিশেষ বুঝলাম না।  ফোনটা হাতের কাছে পেয়ে দুবার কামড়ে দেখলাম যদি আপেলের স্বাদ পাই কিনা।  কিন্তু দাঁতই বসাতে পারলাম না।  এই যে পেরেন্টস কোম্পানি মাঝে মাঝে কি যে ভুলভাল বকে বুঝিনা বাপু।  
কিন্তু কদিন বাদে যখন বাবা নতুন ফোন নিয়ে এলো, তখন বুঝলাম ষড়যন্ত্রের শিকার আমি।  বাবা নতুন ফোন কিনেছে। আমায় দিব্যি দিয়ে দিলো , বলে নাকি আধ্যান প্রুফ। আমি নেড়ে ছেড়ে দেখার আগে চোখ পড়লো সাদা বাক্সটটাতে। পাশেই  পড়েছিল।  তুলে নিয়ে দেখি সেটাতে একটা আধ খাওয়া আপেলের ছবি আর তার ওপর কিছু হাবিজাবি লেখা আর  তারপর একটা কাটা চিহ্ন। কিন্তু একী ? আমার সাধের বাটন নেই। নেই নেই নেই নেই নেই।  তোলপাড় করে খুঁজলাম।  কোত্থাও নেই।  সারা ফোন জুড়ে , শুধু ফোন আর ফোন।  ব্যাটা এই ছিল তোর মনে।  আপেলের বাক্সে ফোন কিনে এনেছে তাও জঘন্য এক ফোন।  গেলাম রেগে , দিলাম থাবড়া, উঠলো জেগে।  বললো , “আই কুডণ্ট হিয়ার ইউ আধ্যান .”


আধ্যানের ডায়েরি

No comments:

Post a Comment