Sunday, October 27, 2019

নাসকা (NASKA) কালী পূজা - 2019



এরা পাংচুয়াল , ভালো আর্টিস্ট আনে আর ভালো মাংস খাওয়ায়। আর এবার দশ বছর নাসকার।  কিছু তো দারুন হবে।  ভেবেই টিকিট টা কেটেই ফেললাম। আগের বার পাংচুয়ালিটির ঠ্যালায় ঠাকুরই দেখতে পাইনি।  এবার ঘড়ি মিলিয়ে তাই ঠিক সময়ে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম নাসকার কালীপূজায়।  আমার দ্বিতীয় , নাসকার দশ। টিকিট কাটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পোস্ট হলো  ওয়েবসাইটে “এবার মাছও আছে।” তাইতো , বাঙালি কে কি শুধু মাংস খাইয়ে রাখা যায়।  একটু মৎস্য অবতার পাতে আশীর্বাদ না দিলে ধাতে সয় না। এবারে তাই নাসকা মানে মাছ , মিষ্টি এন্ড মাটন ।  

পোস্টটা দেখেই বুঝলাম , নাঃ এবারও মোগাম্বো খুশ হবে।  তাই সময়ে গিয়ে হাজির হতেই সেই খেটে ক্ষতবিক্ষত মুখগুলো দেখতে পেলাম।  পরিশ্রমের চাপের ছাপ পরিষ্কার।  এবার নতুন ভেন্যু।  নতুন স্কুলের বাস্কেটবল কোর্টে মা কালী দক্ষিনেশ্বর মন্দির থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এরকম মণ্ডপ গত এগারো বছরে আমার ঘোরা আমেরিকায় তো দেখিনি।  দশের চমক দিতে প্রত্যেকবারের মণ্ডপ সজ্জার দায়িত্বে থাকা মানুষটি এবার বেশিই খেটে ফেলেছেন। সেই বিশাল ব্যাকড্রপের উজ্জ্বল উপস্থিতি, অন্যই মাত্রা এনে দিয়েছিলো দিনটির।  

আমেরিকার পুজোগুলোর একটা বেশ বড় সমস্যা সেলফি কুইন বা কিং-কংদের। বছর বছর পুজোর ছবি পাল্টায় না।  মূর্তিই জোগাড় করা চাপের তো থিম বানানো তো আরো কঠিন।  তাই বছরের পর বছর থাকা মানুষগুলোর ব্যাকড্রপ ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যায় ছবি থেকে।  “বিন দেয়ার ডান দ্যাট ” এরপরে পরে থাকে ফি বছরের সাজগোজ আর বাড়তে থাকা মেগাপিক্সেলের ক্ল্যারিটি।  নাসকার এই ব্যাকড্রপ দেখে নিজস্বীলোভীদের মুখশ্রী বিশ্রী ভাবে দন্তবিকশিত হতে দেখা গেলো ।  আর আমরা সুযোগের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েই থাকলাম। 

তবে হ্যাঁ , এবার পুজো দিয়েছি।  ইয়েস - ইয়েস - ইয়েস।  বলে না , ভক্তি মনে, ওই পুজো টুজো ভালোলাগা শুধু মনের ব্যাপার।  একদম হক কথা।  সমীরণ চক্রবর্তীর পুজো দেখুন বুঝবেন।  হু হু বাবা , নাস্তিকের নাস্তিকতা কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।  গিন্নি আমার বেজায় খুশি পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে।  আর আমি খুশি পূজা পদ্ধতি আর মন্ত্রোচ্চারণ দেখে।  হাজার হোক নিউ ইয়র্ক কালী মন্দিরের পুরোহিত। 

তা পুজো দেখে শান্ত হলে কি হবে এদিকে ছুটে বেড়াচ্ছেন আমার তিন বছরের ধনুর্ধর , যে শুধু দৌড়েই খুশি।  বিশাল বাস্কেটবল কোর্টের এপার থেকে ওপর শুধু ছুটে বেড়াচ্ছেন আর মাঝে মাঝে ঠাকুরের সামনে জমে থাকা ভিড়ের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যাচ্ছেন।  আর আমি পেছন পেছন , “সরি- সরি” বলতে বলতে ছুটছি।  এই ঝড় থামলো যখন ঢাকের কাঠি তার হাতে এলো।  চুটিয়ে ঢাক পিটিয়ে তাঁকে টানতে টানতে নিয়ে আসা হলো প্রসাদ বিতরণীতে। 
 প্রসাদ খেয়ে আমি এই নাকখত দিলাম। পরের বার থেকে আর খাবো না।  মাইরি বলছি , প্রথম প্লেটে ভোগের খিচুড়িটার জাস্ট ছোঁয়া ছিল , তার জন্যেই দ্বিতীয় প্লেট আবার নিলাম, যখন সবার নেওয়া শেষ আর বেশ কিছু খিচুড়ি পরে আছে।  কিন্ত তাতেই হলো গেরো।  পেট গেলো ভরে।  কি করবো , খিচুড়ি ছাড়াও চালমাখা, গোটা গোটা সন্দেশ , গুড়ের নাড়ু , লুচি সবই দুর্দান্ত। মন এবং পেট ভরে গেলেও “মাছ যে টানছে”। 

প্রসাদের বাটি ফেলে এদিক ওদিক বেশ কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি  করলাম। যদি একটু নামে ।  এই কালীপূজা মোটামুটি কানেটিকাটের মিলনমেলা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ছশো বাঙালি সেদিন রকি হিল স্কুলে ঘোরাফেরা করছে। নতুন পুরানো আলাপচারিতা, ‘হাই‘ , ‘হ্যালো ’,  ‘ফাংশন দেখবে ?’ ‘খেয়েছো ‘ ইত্যাদির পর দেখলাম ধীরে ধীরে সবাই হাঁটা দিচ্ছে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে। 

প্রথম ভিড় সামলে উঠে লাইন তখন বেশ  ফাঁকা, কিন্ত টেবিলগুলো ভর্তি।  সুন্দর ধুতি পাঞ্জাবি পরে একজন থালা আর ন্যাপকিন বাড়িয়ে দিয়ে পেছনের লাইনের দিকে উদ্যেশ্য করে বললো , “দুটো লাইনেই এক জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। ভেজ নন ভেজ দুটোই। ” এই শনিবারে পূজা করার এই এক ঝামেলা।  অনেকেই ভেজ।  এতেই আমাদের মতো মানুষের লাভ।  মনে বল ভরসা যে মাছ মাংস শেষ হয়ে যাবেনা।  গিন্নি যদিও ভেজ খেলো।  যখন অর্ধাঙ্গিনী খাচ্ছে যখন বাকি অর্ধেক নন ভেজে মন দিতে পারে।  

শুরু হলো সালাদ দিয়ে যেমন হয় , কিন্ত সাথে আছে পাঁপড় ভাজাও।   এরপর ভেজ পোলাও, বাটার পনির , ডাল পেরিয়ে এলো কোফতা।  তারপর নন ভেজ কাউন্টার।  স্বয়ং অবতার কেলি করছে লাল টুকটুক ঝোলে পাশে অগ্নির বাহন। কিন্তু মিষ্টি কৈ , “পিছে দেখো পিছে” । থরে থরে গুলাব জামুন সাজানো আছে। রসগোল্লা হলে একটু ভালো হতো কিন্তু এই সবথেকে সাধারণ মিষ্টি বানানো যে কি অসাধারণ সমস্যার সে যারা বানিয়েছে তারাই জানে।  

মণ্ডপে ঢোকার আগেই দেখে নিয়েছিলাম নাসকার পেজে, যে মাছ রান্না হচ্ছে ইন-হাউস।  গামছা বেঁধে লেগে পড়েছে একটা গোটা টিম।  এক্কেবারে প্রথম বছরের মতোন, যখন পুরোটাই রান্না করা হতো ঘরে। এবারের এই আকর্ষণে তাই প্রথমে কামড় বসলাম।  ও-র-রে না-আ-আ !!!! এতো সেই পুরানো সর্ষের তেলের ঝাঁজ।  যা আপাতত অনেক হেলথ - এন্ড -হাইজিন - সেন্টার ফ্যামিলিতেই উধাও।  আরেকটা মাছ পাওয়া যাবে !! দেখলাম ছেলের পঞ্চাশ গ্রামের পিসটা পরে আছে।  গিন্নি তখন ছেলেকে মাংস খাওয়াতে ব্যস্ত।  আর কি, ছোঁ মেরে তুলে নিলাম।  গিন্নির অবাক প্রশ্নবোধক চোখের দিকে গম্ভীরভাবে উত্তর ছুঁড়ে দিলাম , “থাক , কাঁটা বিঁধে যেতে পারে। ” 

খাবারের সম্বন্ধে আর বেশি কিছু বলার নেই।  সব কিছুই অসাধাৰণ। খাবারের কোয়ালিটি থেকে শুরু করে পরিবেশনের ধরণ পর্যন্ত এক্কেবারে মিষ্টি।  একটু ঠান্ডা কোল্ড্রিংকস আর পানমসলা থাকলেই ব্যাপারটা নিখুঁত হতো আর কি।  গিন্নিকে বলতে বললো , “এহঃ খেতে পেলে শুতে চায়। এই টেবিলে রাখা কোল্ড্রিংকস খাও।  নইলে ভেন্ডিং মেশিন থেকে নিয়ে নাও। “ কিরকম থতমত খেয়ে ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা স্পার্কলিং ওয়াটারের ক্যান নিয়ে এলাম।  খুলে চুমুক মারতেই দেখলাম ভুল করে ফেলেছি।  আনসুইটেন্ড লেখাটা খেয়ালই করিনি।  

খাওয়া শেষে অডিটোরিয়ামে ঢুকে বসলাম।  এবার আগের বারের থেকে কাচ্চা বাচ্চা বেশি।  মনে হলো কোনো একটা পার্কে এসে হাজির হয়েছি।  এর মধ্যে অনুপম তার মেলোডি গাইবে !!! ভাবলেই অবাক লাগে। অনুপমের অনুষ্ঠান আগে দেখিনি। কিন্ত শয়নে স্বপনে জাগরণে গুচ্ছ গান গুনগুন বা ঘ্যানঘ্যান করতে থাকি অনুপমের।  

অনুপমের গান যেন অদ্ভুত এক মুগ্ধতা। ভালোবাসার মানুষটাকে পাশে নিয়ে জীবনের প্রত্যেক খাঁজে ডুবে যাওয়া মানুষের চাহিদা থাকে শব্দের আর সুরের মেলবন্ধনের। কখনো আকাশ বেয়ে চুপ করে , নেমে আসে ভালোবাসা খুব ভোরে। স্নানের ঘরে জমে ওঠা বাস্পে ভিজে চোখে ঠোঁটে গালে লেগে থাকার স্বপ্ন নিয়ে যতদিন কাছে পাওয়া যায় তাই নিয়ে চলতে থাকে জীবনের টানাপোড়েন। চাওয়া পাওয়ার লড়াইয়ে যা ছিলোনা তা না পেয়ে খুশি থাকার ইচ্ছা ক্রমশ ফ্রিজের পিয়াঁজ কলির মতো শুকাতে থাকে। রাত দুপুরের মিষ্টি আবদারে পাশ ফিরে শোয় মন যখন। বোবা টানেল ধরে ইচ্ছারা ছুটে চলে। ভালোবাসার দেওয়া নেওয়াতে সঙ্গী হয় একাকিত্ব। ঘড়ির কাঁটায় লেগে থাকা আমি তুমির আনন্দ গুলো ভুলে গিয়ে অকারণ বানানের চিন্তায় নিমগ্ন হয় সম্পর্ক। টুঁটি টিপে প্রেম এসে ধরলেও বসন্তের বিকালে একঘেঁয়ে বিষাদ সুর বাজতে থাকে। বুকের ভেতর ফেটে ওঠে অস্তিত্বের মাইন , আর শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রেমের বীজ সৃষ্টি করে এক যন্ত্রনা। পকেট ভরা সত্যি মিথ্যে ব্যাখ্যা করে একে অপরের জীবন।  বুক ফেটে বেরিয়ে আসে , নেই , কেউ নেই তোর , তোর কেউ নেই।  

কিন্তু অনুপম মানুষটার স্টেজ প্রেসেন্স খুবই ভালোমানুষের, ঠিক নতুন আলুর খোসার মতো।  স্টেজ সবার জন্য নয়। স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে হাতে মাইক নিয়ে গান করাটাই শুধু প্রোগ্রামের অংশ নয়।  প্রোগ্রামে ব্যাগে নিতে হয় অডিয়েন্সকেও।  অনুপমের সং রিকোয়েস্ট রেসপন্স শুনে গাল টিপে দিতে ইচ্ছা করবে।  কি মিষ্টি একটা লোক ! মনে হয় সেই কারণেই অতো ব্যাথা খেয়ে গান লিখতে পারে। নিজেই মেনে নিলো সেই কথা , “আমি সবসময় শুনি যে আমি শুধু কেঁদে ভাসানোর গান লিখি। তাই আজকে একটা নাচের গান , “মিথ্যে কথা ”। 

কিন্তু পাগল করার মতো একটা জ্যামিং কম্পোজিশান ছিল।  স্যাভি , প্রশান্ত , অয়ন আর অশ্রুজিতের উত্তাল সেই পারফর্মেন্স কাঁপিয়ে দিয়েছিলো ছোট্ট অডিটোরিয়ামকে।  কলেজ লাইফের রক ব্যান্ডগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো সেই আট মিনিটের কম্পোজিশান। 

নাঃ এবার আর ছবি তুলতে পারলাম না অনুপমের সাথে।  এক অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে।  ঠিক সেই অনুভূতি নিয়ে যার অপেক্ষায় ছিলাম এক বছর।  আবার থাকবো গোটা একটা বছর।  প্রোগ্রামের শুরুতে নাসকার কমিটি বুঝিয়ে দিলো যে তারা নতুনের হাতে তুলে দিয়েছে অনেক কার্যভার, যা যেকোনো শক্তিশালী সংগঠনের মূল স্তম্ভ।  তাই বছর বছর নতুনের আবির্ভাব আর বৈচিত্রের মুগ্ধতা দেখতে পাবো বলেই আশা করি।  সেই আশা নিয়েই আমার তরফ থেকে , “আসছে বছর আবার যাবো।” দশ বছরের অনেক শুভেচ্ছা নাসকা কে ,বলার আর কি আছে  
 “আসছে বছর আবার হবেই - হবে । …… ”       

2 comments:

  1. দাৱুন হয়েছে লেখাটা। একেবাৱে মুগ্ধ। মনে হচ্ছিল চোখেৱ সামনে দেখতে পাচ্ছি সব এতটাই জীবন্ত এবং সাবলীল।

    ReplyDelete
  2. Asadharon, r apnar thik j feelings r kotha likhechen ek e anuvuti amar o. Specially apni ullekh korechen jam r kotha...much r kalia r kotha r mutton kosha.sob milie amar prothom advut memorable experience in life.

    ReplyDelete