প্রথম পর্বের লিংক
পরের দিন সকাল থেকে মা বেশ খুশি খুশি । আজ নাকি আমরা যাবো মামার বাড়ি। আমার বাড়ি থেকে মামার
বাড়ি। সেখানে নাকি গিয়ে আমি যা খুশি তাই করতে পারি। সকাল থেকেই বাড়িতে সাজ সাজ রব। একটা লাল টুকটুকে গাড়ি
করে আমরা যখন মামার বাড়ি রওনা হলাম তখনও সেই এক কেস, আমি মায়ের কোলে। আমার কোনো
সিট্ নেই। এ কি রে বাবা। কিন্তু
যখন গিয়ে পৌছালাম তখন দেখি সেই আমার দাদু দিদা , যারা
আমার ওখানে অনেক দিন ছিল তারা এসে হাজির। সাথে এক
নতুন লোক, যে এতদিন ফোনে থাকতো - মাসি।
গরমটা সয়ে গেছিলো। আমরা একটা
বিশাল গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। কিন্তু এ কি ? আমার কার সিট্ কৈ ? সে তো ছাড়ো , আমার সিট
কই ? অপেক্ষা করতে লাগলাম। এক সময়
দেখি গাড়ি ছেড়েও দিলো। আমি তখন
ঠাম্মার কোলে। কার সিট নেই, সিট বেল্ট নেই , আর শক্ত সিটের থেকে ঠাম্মার কোল সব
সময় ভালো। বাবা সামনের সিটে বসে আছে। বাবা ড্রাইভ করছে না। অন্য একটা
লোক করছে। বাবা বার বার পিছনে ঘুরে ঘুরে আমায় দেখতে লাগলো। আমি লক্ষ করছিলাম বটে , কিন্তু এখন আমার দেখার জন্য
অনেক বেশি কিছু আছে। এখানে
জানলা দিয়ে অনেক কিছু দেখা যায়। কত গাড়ি। একদম পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কত লোক। একদম
গাড়ির সামনে দিয়ে কত লোক হাঁটছে। শুধু খুব
আওয়াজ। সবাই হংক করছে। আমার দেশে
একটা হংক শুনলেই বাবা - মা দুজনেই প্রচন্ড উত্তে
জিত হয়ে পরে। সবসময় মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে থাকে। কিন্তু এখানে সেরকম ভাবে দেখতে গেলে তো মাথা সোজা
রাখাই যাবে না। আর আমাদের
যে গাড়ি চালাচ্ছে সে তো বার বার হংক করছে। এতো বার
তো বাবা বা মা করে না। কিন্তু
আমার বেশ মজা লাগছে। আওয়াজ হলে
ভালোই লাগে বেশ। বেশ মনে
হচ্ছে ড্রাইভার অন দা বাস গোস পি-পি-পি - পি-পি-পি অল থ্রূ দা টাউন।
আগে পিছে এতো গাড়ি আছে বলে গাড়ি খুব আস্তে চলছিল। খুব খু-ও-ও-ব আস্তে। তাতে যদিও
আমার সুবিধা হচ্ছিলো , কারণ আমি সব কিছু দেখতে দেখতে যেতে পারছিলাম। এখানে তো আর সেই একঘেঁয়ে একই গাছগাছালি দেখতে হয় না। নানা ধরণের বাড়ি , নানা ধরণের হোর্ডিং , নানা ধরণের
গাড়ি। ও হ্যাঁ , আমি তো থ। কত ধরণের
গাড়ি এখানে। পুরো ট্রিপ যখন শেষ করলাম তখন অনেক অনেক গাড়ি দেখে
ফেলেছি। সেই গল্প আসতে আসতে বলবো।
হঠাৎ করে কি যেন হলো সব কিছু ধুলোয় ঢেকে গেলো। ঠাম্মা আমার মুখ ঢাকা দিতে গিয়ে চোখের ওপর হাত রেখে
দিলো। মা কাশতে আরম্ভ করে দিলো। বাবা কিন্তু এস ইট ইস। মুখ পিছনে ঘুরিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগলো মায়ের
ওপর , আর বলতে লাগলো , ‘ শুরু হয়ে গেলো তো এন আর আই ন্যাকামো’। এন আর আই যে কি
জিনিস জানিনা। তবে আমার সারা মুখ কচকচ করতে লাগলো বালিতে। গাড়ির কাঁচ গুলো বন্ধ করে দিতে গিয়ে হলো উল্টো
বিপত্তি। ঘেমে নিয়ে স্নান করে গেলাম আমরা। তার থেকে ধুলোই ভালো। আমার
বিশেষ কষ্ট হচ্ছিলো না , আই মিন আমি বিশেষ পাত্তা দিচ্ছিলাম না। তখন আমার মন গাড়ির চারপাশে দৌড়াতে থাকা নানা জিনিসে।
আমরা যতক্ষণে বাড়ি পৌছালাম ততক্ষনে একদম ঝুলে গেছি। বার বার ধুলো খেতে খেতে ব্যাপারটা প্রথমে কিছু মনে না
হলেও পরে কেসটা ঠিক জমে নি। ঘরে ঢোকার
আগে আরো কয়েকজন আমাকে চটকে নিলো। আমিও চলে
গেলাম সবার কোলে কোলে। সবাই
খুশি। কিন্ত আমি তখন আমার প্লে গ্রাউন্ড খুঁজে বেড়াচ্ছি।
ঘরে ঢুকেই খাটে উঠে পড়লাম। খাটের
গায়ে আবার ছোট একটা ব্যালকনি। জানলা
দিয়ে ঢুকতে হয়। আমাদের
জানলা দিয়ে ঢোকা যায় না। কিন্তু
এখানে দিব্যি। বেশ মজাদার সেই জানলাটা। ঠিক যেন আমার জন্য বানানো। আমি উঠে গিয়ে চিৎকার করে ওয়ান তু থি বলে দিলাম সবাই
কে। ঠাম্মা দাদু আমার পেছনে দৌড়ে গেলো। হেব্বি খেলা , শুধু খেলা , কিছুক্ষন পরে খাবার দাবার
শেষ হয়ে যেতে একদম ঢুলে পড়লাম। বাবা এসে
সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমাকে
ঝাঁকিয়ে টাকিয়ে অনেক করে জাগিয়ে
রাখার চেষ্টা করলো। আর বলতে
লাগল , ‘ জেগে থাক , নাহলে জেট ল্যাগ হবে। ‘
জেট ল্যাগ যে কি জিনিস সে তো আর সেদিন বুঝিনি। শুরু হলো সেদিন রাত থেকে পাগলামো। রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। তার ওপরে এখানে আবার টিভি তো অনেক ওপরে। দেয়াল থেকে ঝুলছে। আমি না পারছি ডেভ আর এভা কে ধরতে। না পারছি মাংকি গুলোকে চুমু খেতে। কিন্তু যেটা পেয়েছি সেটা হলো ক্রেয়ন। নামটা খটোমটো হলেও কি দারুন লাগে ওগুলো দিয়ে লিখতে। দাদু এসে ধরিয়ে দিতেই আমি দেয়াল দিলাম ভরিয়ে। ঠাম্মা আবার অনেক বই এনে রেখেছিলো আমার জন্য। নতুন বই পড়তে কার না ভালো লাগে। কিন্তু রাতের ঘুম
নিয়ে চিন্তায় পড়লো সবাই। শেষমেশ
বাবা বললো আমি দাদু ঠাম্মার কাছে শোবো।
ব্যাপারটা খুব একটা ভালো লাগলো না আমার। মানছি দাদু ঠাম্মা আমার নিজের, কিন্ত যতই হোক ,
আমার রাতে মা কে লাগে। কিন্তু
আমি প্রোটেস্ট করিনি। দাদু
ঠাম্মার কাছেও শুয়ে দেখে নি। ক্যারোল বলেছিলো ইটস দা সুইটেস্ট টাইম। কিন্তু সবথেকে মজাদার ব্যাপার হলো, খাটের মধ্যে কি যেন একটা দিয়ে আর একটা রুম বানিয়ে দিলো। ভেতরে ঢুকতে পারবে , কিন্ত বেরোতে পারবে না। ভেতর থেকে দেখলাম মা অনেক বার কাঁচু মাচু মুখ করে চলে
গেলো। কিন্তু আমার তখন সেসব দেখার সময় নেই। আমি তখন ঘরের মধ্যে ঘর নিয়ে মশগুল। আর দাদু ঠাম্মা নিয়ে। সত্যি
ক্যারোল ঠিক বলেছিলো। ইটস দা
সুইটেস্ট টাইম।
একটু চোখ লেগে গেছিলো কিন্তু তারপরেই উঠে অন্ধকার
ঘরেই আমি চালু করেদিলাম টু থি ফোর। রোজ রাতে
বাবা মা কে জ্বালাই। আজ না হয়
অন্যদের। বাবা মা বিরক্ত হয়ে যায় , কিন্তু ঠাম্মা দাদু তো
বিরক্ত হয়নি। সারাক্ষন লাফালাফি করে দেখি সকাল হয়ে গেছে। বাবা এসে আবার নিয়ে গেলো মায়ের কাছে। মা তখন জড়িয়ে সরিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। আমারও চোখ জুড়িয়ে এলো।
পরের দিন কত কত লোক এলো আমাকে দেখতে। আমি সবার কোলে গেলাম। সবার সাথে
খেলা করলাম আর করলাম খাওয়া নিয়ে যুদ্ধ। এখানেও
খিচুড়ি। ধুর আর ভালো লাগে না। বুঝতে
পারছিলাম একটা চাপা টেনশন চলছে আমার খাওয়া নিয়ে। কিন্তু
আমার কিছু করার নেই। আমার
মোটেও ভালো লাগছিলো না। শরীরটা
ক্যামন যেন একটা করছিল। তার ওপর
সেই একই ওট আর দই, আর না হলে খিচুড়ি। সবাই মিলে
চেষ্টা করে দেখে নিলো আমাকে খাওয়ানো যায় কিনা। কিন্তু
আমি কাউকে এলাও করলাম না। শেষে সেই
মোষের মতো বাবা ঘাড় ধরে খাইয়ে দিলো।
তাহলে এটা মাসির বাড়ি , মামার বাড়ি নয়। মামা নেই। আছে দাদু
দিদা আর মাসি। আর আছে আমার জন্যে আগে থেকে কিনে রাখা তিনটে গাড়ি। কি সুন্দর গাড়ি গুলো। লাল হলুদ
আর সাদা। লালটা ধরে ছুঁড়ে দিলাম প্রথমে। দেখলাম নাহ , বেশ টেকসই। আর এখানে খাটটা বেশ উঁচু , তাই আমি একটার পর একটা
গাড়ি খাটে তুলতে লাগলাম আর কাউন্ট করতে লাগলাম। বেশ মজা। মাসি আবার হাতে কিছু একটা নিয়ে দূর থেকে লাল গাড়িটাকে
সরিয়ে দিচ্ছিলো। আমি
কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না হাতের ঐটা কি। যখন বেশি
ঝামেলা করলো দিলাম গাড়িটাকে ভেঙে। আমাকে নিয়ে চ্যাংড়ামো আমি বিশেষ বরদাস্ত করতে
পারিনা। মাসির সাথেই আমার বেশি খেলা ছিল। দিদা দাদু
তো নড়তেই পারে না। কিন্ত মাসির সব কিছু ভালো শুধু আমার একটা বিচ্ছিরি নাম দিয়েছে -
নানটু। ছি এটা আবার একটা নাম হলো। কিন্তু আমার বিরক্তির কথা এখন তো আর ভাষায় প্রকাশ
করতে পারিনা , তাই মেনেই নিলাম।
বেশ কয়েকদিন ওখানেই কাটালাম। অনেক কিছু দেখলাম , অনেক কিছু নতুন লাগলো। কিন্তু সবথেকে মজা লাগলো ছাদে গিয়ে। ছাদে অনেক পাখি থাকে। আমার দেশে
আমি তো কখনো ছাদে উঠিনি। তাই পাখিও
দেখিনি। ইন ফ্যাক্ট দেখেছি, কিন্তু এতো কাছ থেকে দেখিনি। পাখি গুলো আবার বক বক বকম করে আওয়াজ করে। মাসি ওদের খেতে দেয় আর ওরা এসে লটপট করে পায়ের কাছে। আমি যেই না ধরতে যাই সেই উড়ে চলে যায়। কি ভালো লাগে , ওদের ওড়া দেখতে। আমি কেন উড়তে পারিনা।
জানিনা বাপু। একটু
চেষ্টা করেছিলাম , থপ করে পরে গেলাম।
মাসি সবাইকে খেতে দেয়। এখানে রাস্তায় কত কত বিংগো আছে। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালেই অনেক অনেক বিংগো দেখতে পাই।
সবাই খেলা করে। আর মাসি
ওদের খেতে দেয়। আমার কি
যে ইচ্ছা করে যে একবার গিয়ে ওদের ধরে চটকে দিই। একবার
বাবার পেছন পেছন বাইরে বেরিয়ে হাত ছেড়ে চোঁ চা দৌড় লাগিয়েছিলাম একটা বিংগোর পেছনে।
কিছুটা যাওয়ার পর দেখি বিংগো টা ঘুরে দাড়িয়েছে। বাবা পিছন থেকে দৌড়ে আসছে আর মাসি চিৎকার করছে , ‘ওটা
কামরায় - ওটা কামড়ায় ’ । কামড়ায় ! তাতে আবার কি। আমিও তো
কামড়াই , আমার মাঝে মাঝেই দাঁত সুরসুর করে আর আমি দিই ঘ্যাঁক করে কামড়ে। তাতে তো সবার মজাই লাগে। তাহলে কি বিংগো যদি কামরায়
তাহলে সমস্যা। কি জানি। জানিনা।
এখানে বেশ কিছু মু মু আছে। বেশ বড় , বড়। বেশ দুলকি
চলে বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যায়। সবথেকে
মজার ব্যাপার কি জানো , এখানে প্রচুর লোক। বারান্দায়
এসে দাঁড়ালে পর পর সামনে দিয়ে লোক চলে যায়। আমি তাদের
সাথে কথা বলতেই থাকি , বলতেই থাকি। মাঝে মাঝে
কেউ কেউ এসে দাঁড়িয়ে কথা বলে। আবার চলে
যায়। আমি ওই গ্রিলের ওপারে কিছুতেই যেতে পারিনা। অনেকবার চেষ্টা করে দেখেছি।
একদিন রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখি কি ভয়ানক সাউন্ড। সারা বাড়ি কাঁপছে। খাট
কাঁপছে, বিছানা কাঁপছে , মা কাঁপছে কিন্ত চোখ খুলছে না। ভয়ে সিঁটিয়ে মায়ের কোলে ঢুকে পড়েছিলাম। ঘুম আসেনি , কিন্তু পরের দিন দাদুর সাথে বেড়াতে গিয়ে
বুঝতে পারলাম সেটা ট্রেনের আওয়াজ। আর ট্রেন
চলে গেলে সব কিছু কাঁপতে থাকে। এতদিন
আমাকে সবাই মিলে মুরগি করেছিল। ট্রেনের
নাকি আওয়াজ কু ঝিক ঝিক ঝিক। মোটেও না।
ধুধুম ধুধুম ধুধ ধুধ ধুধুম ধুধুম ধুধ ধুধুম ধুধুম ধুধ
ধুম। এরকম আওয়াজ। আমি রোজ
দাদুর সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছি। দাদু আমাকে ট্রেন দেখিয়েছে , গাড়ি দেখিয়েছে , ঠিক যেমন
আমার বাড়িতে যখন দাদু ছিল তখন যেমন দেখাতো। এখানেও
তেমন। কিন্তু ওটা তো
দাদুর জায়গা নয়। দাদু তাই
বেশি কিছু দেখতে পারতো না। এখানে তো
দাদু সব চেনে , তাই অনেক কিছু দেখিয়ে দেখিয়ে আমায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসতো।
No comments:
Post a Comment