Tuesday, November 6, 2018

নাসকা (NASKA) কালী পূজা



টিকিটটা কাটবো - কি কাটবো না সেই নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে দোনামোনা করছিলাম।  কানেটিকাটে এই প্রথম কালীপূজা আমার। কিন্তু আমার টেরিবল টু পুত্র কে নিয়ে দু-ঘন্টা প্রোগ্রাম দেখা রীতিমতো একটা স্বপ্নসম।  এই তো কদিন আগে দূর্গাপূজায় গিয়ে সোজা কলাবৌ কে টেনে নামিয়ে দিয়েছিলো।  আর রিস্ক নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না।  কিন্তু ওদিকে টানছিলো চন্দ্রবিন্দু আর পাঁঠার মাংস। 

এখানে একটু বলে নিই নাসকা(NASKA)  বা নর্থ আমেরিকা সার্বজনীন কালীপূজা এসোসিয়েশন সম্বন্ধে।  ভেতরের খবর - ইতিহাস - কে কাকে কি করেছে সেসব নয়।  বৃক্ষ ফলেন পরিচয়তে।  লোকমুখে যা শুনেছিলাম, তার তিনটে পিলার ছিল  - এরা পাংচুয়াল , এরা ভালো পাঁঠার মাংস খাওয়ায় আর ভালো ভালো আর্টিস্ট আনে। কথাটা সত্যিই সত্যি।  এই তিনটের ব্যাপারে এবার একটু বিস্তারিত বলি। 

বাঙালির পুজো উপোষে পাপোস হয়ে , ভয়ে ভয়ে ঠাকুরের সামনে হত্যে দিয়ে পরে থাকা না।  বরঞ্চ গান্ডে পিন্ডে গিলে শাড়ি ধুতি পাঞ্জাবি পরে উদমা নাচ আর "আসছে বছর আবার হবে" র প্রমিস।  অন্তত দশটা ভাষায় পুজোহুঙ্কার শুনে দেখেছি এই সামনের বছরের প্রমিস বা কমিটমেন্টকে একটা বিশাল আওয়াজ কেউ বানাতে পারেনি।  এই আসছে বছর আবার কি করে হবে।  হতে হলে যা যা করতে হয়, নাসকা ঠিক তা-তা করে। 

কলকাতা থেকে এতো দূরে এই পগার পারে আটকে থাকা ( ডলারের জন্যেই হোক, বা ভালোবেসেই হোক ) মানুষগুলো চায় কি ? বহুদূর ড্রাইভ করে  এসে  একটু টাইমমতো পুষ্পাঞ্জলি আর একটু ভালো খাওয়া আর খাওয়ার শেষে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে একটু ভালো পোগ্গাম। ব্যাস আর কিছু নয়।  কাজের লোক নেই , তাই ঠাকুর দেখে ফিরে গা এলিয়ে পরে থাকার উপায় নেই।  তাই সময়মতো যাওয়া আর সময়মতো ফিরে আসা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।  নাসকা কালীপূজা দেখতে এক থেকে দু ঘন্টা ড্রাইভ করে আসা লোকেদের অভাব নেই।  তারা যদি এসে দেখে পুষ্পাঞ্জলির অনেক দেরি হয়ে গেছে তাহলে তারা আর পরের বছর থেকে পয়সা দেবে না।  নন প্রফিটেবল অর্গানাইজেশন দের এই এক সমস্যা , তারা চাঁদা আর ডোনেশনে চলে, আর সেই কারণেই  "দে কেয়ার" । নাসকার নিয়মানুবর্তিতা অসাধারণ। সামনের বছর দশ বছর বয়স হবে এই পূজার , কিন্ত এক্কেবারে টাইমবাবু।  এতটাই টাইম মেনে চলে যে এবার আমরা গিয়ে হাজির হয়েছি , আর তখন ঠাকুর প্যাক হচ্ছে।  হবে না কেন ? আমরা বেশ লেট্ হয়ে গেছিলাম। একটা নতুন কাস্টমারের লেটের সাজা বাকিদের দেওয়া হবে কেন।  তাই আমরা নাসকার কালীমূর্তির সাথে সেলফি তুলতে পারিনি। 

দ্বিতীয় হলো খাওয়া।  খিচুড়ির সাথে পূজার স্ট্যাম্প আছে বটে, কিন্তু ঠাকুর - মানুষ এক লেভেলে আজকাল আর ফেলতে চায়না কেউ।  তাই ঠাকুর যা খাচ্ছে খাক।  আমরা একটু মাংস খেয়ে নি।  মা তুমি খিচুড়ি ভোগ নাও , আমরা কিছু পাঁঠা পেঁদিয়ে আসি।  এই উচ্চমেধাসম্পন্ন জাতির পাতে নিম্নমেধার বলি নিতান্তই উপভোগ্য।  নারকীয় উল্লাসে কব্জি ডুবিয়ে পাঁঠার মাংস না খেলে কি কালীপূজা মানায়।  তাই "নাসকা" রসনার পরিতৃপ্তি আর বাঙালির জিভের আল্টিমেট ডিম্যান্ড সাকসেসফুলি ডেলিভার করে বছরের পর বছর।  পুজো শেষে পাঁঠার মাংস আর ভাত। সিম্প্লিসিটি ইস দা কি।  একশো মেনু করে পাঁঠার মাংসের কনসাম্পশন কমিয়ে দেওয়ার টার্গেট এরা রাখেনি।  এবারের মেনুতে  সাদা ভাত, নান , একটা মিক্স ভেজ ,ডাল ,  পাঁঠার মাংস আর গুলাব জামুন।  আর তাতেই ধন্য ধন্য সুখ্যাতি। আমি তো প্রথমবার, তাই মাংসে যেই কাড়ি পাতা পড়েছে একটু ব্যাকফুটে চলে এলাম , "পাঁঠা তাও সাউথ ইন্ডিয়ান। ধুর ধুর ধুর। " কিন্ত একবার মুখ তুলে খাবারের হলে ভিড়টা দেখে ইয়েল্প এ "বেঙ্গলি রেস্টুরেন্ট" সার্চ মারতে শুধু হতাশাই উঠে এলো।  ল্যাদ খাওয়া এতো গুলো বাঙালির পেট পূর্তি করতে নিজেদের রান্না করা রীতিমতো একটা চাপের ব্যাপার।  রেস্টুরেন্ট থেকেই অর্ডার করতে হবে।  আর ত্রিসীমানায় বাঙালি রেস্টুরেন্ট নেই। কিন্তু সেটাও হয়তো হবে আগামী কয়েক বছরে মধ্যে, যখন আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ কোমরে গামছা বেঁধে নেমে পড়বে পাঁচশো লোকের " মাংসের ঝোল " নট "গোট কারির" ব্যবস্থা করতে। 

তৃতীয়তেই তো আটকা পড়লাম।  গত ন বছরে কোনোবারই নাকি এরা কন্ঠী আনেনি। যাদের সামনে থেকে দেখার ইচ্ছা সবার মনেই থাকে সেরকম লোকই এসে দাঁড়ায় এদের স্টেজে।  এবার ছিল চন্দ্রবিন্দু।  চন্দ্রবিন্দু ???? সে তো তিরিশ বছর পুরোনো মমির দল। ও তাই নাকি ? তাহলে আপনিও,  সরি তুমিও - সরি তুই তুই তুই একটা ইয়ে , মানে একটা ----- ছাড় , ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করলাম না। আমার কলেজ লাইফ চন্দ্রবিন্দুর মিডলাইফ ক্রাইসিসের টাইমের।  তখনও পুরোনো স্মৃতি মাখা গানটান চলছিল।  ব্যালাড , মিষ্টি  আর খেজুর , ফসিলের রগরগে রকের পাশে চাপা পড়ছিলো বটে। কিন্তু ব্যাথা খেয়ে মাথা ঝাঁকানো একদিন থেমে যেত, আর ক্যাসেটে ফিরে আসতো "মন রে ". জীবনমুখীর সোজা থাপ্পড় থেকে তখন  ব্যাঁকা হাসির তাচ্ছিল্যে মজে গেছিলাম একের পর এক পলিটিকালি ইন্কারেক্ট গানে।  একটা কথা জেনে রেখো ভায়ারা - হাসা খুব সোজা তবুও কেউ হাসে না , আর হাসানো খুব কঠিন তাই কেউ পারে না।  তাই চন্দ্রবিন্দু ধরে ঝুলে আছি বহু বছর। 

একটু বেশিই ইমোশনাল হয়ে নাসকা থেকে টপিকটাই পাল্টে দিলাম।  আর পাল্টাবোই না কেন।  এবার তো কালীপূজা বা মাটন তো আমাকে এই সাংঘাতিক সাহসের কাজ করতে বাধ্য করেনি।  করেছে যে , সে হলো চন্দ্রিল। আমাদের পুরো গ্রূপটাই চন্দ্রিলের বিশাল ফ্যান।  আমাদের পেছনে একটা তার গুঁজে দিলেই বায়ুবিদ্যুৎ তৈরী হতে থাকবে যদি চন্দ্রিলকে সামনে বসিয়ে রাখো।  এক বন্ধু সৈকত তো ছেলের নামই রেখে দিলো চন্দ্রিল।  সেই চন্দ্রিল যদি আসে তো চন্দ্রবিন্দু দেখতে সমস্ত বাঁধা বিঘ্ন অতিক্রম করে যেতে হবে। 


যেই না শিকাগোর চন্দ্রিলের ইন্ট্রোডাকশন ভিডিও ভাইরাল হলো, ফট করে টিকিট কেটে ফেললাম, আর রোজ ছেলেকে ট্রেন করতে লাগলাম কি করে দু ঘন্টা এক টানা ইউটিউব দেখানো যায়।  সে তো সারাদিন দেখতে পারে।  কিন্তু এক জায়গায় বসে , কিছু না করে শুধু ইউটিউব দেখতে হবে দু ঘন্টা।   ছেলে যদিও অবাক, "এ কি রে বাবা , যে মালটা টিভি খুলতে দেখলেই রঘু ডাকাত হয়ে যায় সে কি করে দু দু ঘন্টা টিভি দেখতে দিচ্ছে তাও আবার হেডফোন লাগিয়ে। "   পরিশ্রমে ফল দিলো আর হেডফোনটা হলো মাস্টারস্ট্রোক। ফ্রম ইন্ট্রোডাকশন টু বাগিয়ে কালী লোক হাঁসালি "ডেভ এন্ড আভা" আমার ফোনে বাজতে লাগলো। চূড়ান্ত নস্ট্যালজিক।  স্কুল প্রেম , কলেজ প্রেম , রাজনীতি , ডিমনিটাইজেশনে এটিমের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা , কার্ণিভ্যাল টু ভুলভাল শুনতে শুনতে কেমন একটা যেন হয়ে গেছিলাম। 

জুজু গাইতে শুরু করে অনিন্দ্য একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে পরে বাচ্চাদের স্টেজে ডেকে নিয়েছিল , আর তাতেই হলো কেলোর কীর্তি।  প্রথমে একটা দুটো বাচ্চা থেকে ধীরে ধীরে একশো বাচ্চা স্টেজে গিয়ে উঠে পড়লো।  এবং ফলপ্রসূত তার টার ছিঁড়ে একসার অবস্থা।  সাউন্ডম্যান সৌগত ( যে গত পাঁচ বছর ধরে ফিলাডেলফিয়া থেকে শুধু NASKAর সাউন্ড করতে আসে )  অসাধারণ দক্ষতায় সাউন্ড ফিরিয়ে আনলো বটে কিন্তু বাচ্চাদের আর ওঠা হলো না স্টেজে।  সেই চৌবাচ্চাগুলোর মধ্যে আমার প্রোডাক্টটা ছিল না।  কারণ সে তখন চু চু টিভিতে মশগুল ছিল। 

গান টান শেষ হতে জুল জুল করে তাকিয়ে ছিলাম স্টেজটার দিকে।  চন্দ্রিলের সঙ্গে যদি একটু কথা বলা যায়।  যদি একটু ছুঁয়ে দেখা যায়। লোকটাকে।  চুল নেই , রোগা টিকটিকি , অদ্ভুত দর্শন এই লোকটার কি বীভৎস আকর্ষণ।  কি বলবো জানিনা।  ছবি তুলবো ? না না ন্যাকামো হয়ে যাবে।  ওই অটোগ্রাফ টটোগ্রাফ আমার ঠিক পোষায় না।  তাহলে কি চাই। গিয়ে বলবো , "আমি লেখালিখি করি।  "দেয়ালা" বলে আমার একটা ব্লগ আছে।  "আনাড়ি মাইন্ডস" এও লিখি।  বলবো।   তার কিছু যায় আসে না।"  কিন্তু স্যার এই আমার হোমওয়ার্ক- এই কথাটা  প্রিয় স্যারের কাছে বলতে কি ইচ্ছাই না করে। জানিনা।  বুঝতে পারছিলাম না।  কিন্তু ওই লোকটার পাশে একটু দাঁড়াতে খুব ইচ্ছা করছিলো। আরো দাম দিয়ে টিকিট কাটলে হয়তো ওদের সাথে ডিনার করার সুযোগ পাওয়া যেত।  কিন্তু কিপ্টেমোর ( ডলার --  আর কি ) জন্য আর  কাটিনি। 

পা টিপে টিপে হাজির হলাম ব্যাকস্টেজে।  কেউ আটকালো না।  দেখলাম চন্দ্রিল দাঁড়িয়ে আছে।  আমার গলা দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না।  ক্যামেরাটা এগিয়ে দিলাম একজনের হাতে।  ছবিটা তুলতে ঘেঁষে দাঁড়ালাম চন্দ্রিলের সাথে।  মাথা তখন প্রচুর কথা বলে যাচ্ছে।  এক গাদা কথা মাথার মধ্যে বলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো , "থ্যাংক ইউ।" চন্দ্রিল শুনতে পেলো না তার লেখার প্রতি , তার আঘাতের প্রতি , তার প্রশ্ন তোলার প্রতি কত কিছু বলে আমি তাকে "থ্যাংক ইউ।" বললাম।  তার পর বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম।  কিন্তু সেই সব কথা বলা হয়নি যা বলতে চেয়েছিলাম। 


প্রচন্ড এক খুশি নিয়ে সেদিন ফিরে এসেছিলাম বাড়িতে।  সেই বাঙালি মনটা নিয়ে যে ঠিক টাইমে গিয়ে পুষ্পাঞ্জলি তো দিতে পারেনি , কিন্তু মাংসের ঝোল খেয়ে , পোগ্গাম এনজয় করে , অন্য ধরণের এক পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে সময়মতো ফিরে এসেছে তার নিজের ডেরায়।  এতেই মনে হয় নাসকা র সাফল্য আর আশা করি "আসছে বছর আবার হবে।"

Chandrabindu Introduction 
https://youtu.be/wGVtct8CnZE

Chandrabindu Geetgobindo 
https://youtu.be/NFjg79U-wY8

অর্ক ভট্টাচার্য  https://www.facebook.com/arkalekhalekhi/
https://arkalekhalekhi.blogspot.com/


1 comment:

  1. Osadharon Bakya Vongima...Just Nostalgic mone hochhilo porar somy...Carry on Dada

    ReplyDelete