নাটক করিস না তো সবাই। মায়ের আবার দিন হয় নাকি। তোদের যদি মায়ের জন্য আলাদা দিন ঠিক করতে হয় তাহলে
আমি এই খেলাতে নেই। আমার মা রোজ আমার মা। আমার মা
কে মনে করার জন্য আলাদা একটা দিন লাগে না। সময় লাগে। মানে সব সময়, মা আমার মা। কিন্তু ঘুমানোর সময় সেন্স থাকে না ,তাই আর কি। কালকে থেকে মা কে সবাই ফোনে বলে চলেছে , "তোর
তো এবার প্রথম মাদার্স ডে, ছেলে কি দিচ্ছে।" কি দেব ? পিয়ার প্রেসার। আমি অসহায় এখন। দেওয়ার মধ্যে আমার শুধু আছে হাসি। সে ছাড়া পসিটিভ কিছু দেওয়ার নেই। তাই দিচ্ছি সকাল
থেকে।
কিন্তু হে ভগবান আমি করবো টা কি। আমিও তো সেই রোজকারের মতো খাচ্ছি খেলছি পটি করছি আর ঘুমোচ্ছি। এই সোশ্যাল ন্যাকামোতে আমার এই ছোট্ট জীবনে এক মহা দুর্জয় নেমে এসেছে। সেদিন ওয়ালমার্ট গেছিলাম , যেহেতু মাদার্স ডে তাই সারা ওয়ালমার্ট এ মা ছড়াছড়ি। সব কিছুতেই থ্যাংক ইউ মম, আই লাভ ইউ মম এই সব লেখা আছে। সবাই কিনছে। যদিও যারা কিনছে তারা এখন আর ডাইপার পরে না। কিন্তু তাও আমি একটু ডিপ্রেস হয়ে গেছিলাম। আমায় মা কার্টে বসিয়ে নিয়ে যায়। আমিও নানা কিছু দেখতে দেখতে অনেকের সাথে কমুনিকেটে করার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে সমবয়সী পেলে কথার উত্তর পাওয়া যায়। বাকিরা তো ট্রান্সলেটই করতে পারে না। যাইহোক একটা জাপানি ছেলে ছিল। ওকেই প্রশ্ন করতে ওও দেখি আমার মতোই ডিপ্রেসড। বেশি ঘাঁটালাম না কারণ ততক্ষনে একটা মেয়ে এসে গেছিলো পাশের কার্টে। ও দেখি কুলকাল। আসলে আমি তো আর কোনোদিন মা হতে পারবোনা তাই ব্যাপারটা প্রাক্টিক্যালি না দেখে সোশ্যাল প্রেসারে ইমোশনালি দেখছিলাম। মেয়েটির না শেরিন। সাদা কিন্তু চুল কালো। আমায় বললো , "কিনতে তো কিছু পারবি না। তাহলে একটিভিটি দিয়ে মম কে হ্যাপি রাখলেই পারিস।" আমার না তখন চোখে জল এসে গেছিলো। ব্যাপারটা যে এতো কঠিন ঠিক বুঝতে পারিনি বুঝতে পারিনি। তখন মনে হয়েছিল স্বয়ং দেবী দূর্গা হালুম থেকে নেমে কার্টে চড়ে এসে আমার প্রব্লেম সল্ভ করছে। খুশি খুশি মনে , অনেক থ্যাংক ইউ বলে আমি যখন ব্যাক করলাম তখন আমি সংকল্প বদ্ধ যে মাদার্স ডে তে মা কে সব জিনিসে খুশি করে দিতে হবে। আর তাতেই আমি গেছি ফেঁসে।
আজ সকালে যখন ঘুম থেকে উঠি তখন দেখি
মা ঘুমাচ্ছে। বেশ মিত্তি লাগে যখন মা ঘুমায়। একদম চুপচাপ , বাকি সময় শুধু পিড়িং পিড়িং আর সব
দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় আর বলে, "এই দামাল ছেলেকে নিয়ে আর পারিনা।" কে
বলেছে শুনি তোমার আদ্যিকালের ডিভিডি প্লেয়ারকে বাঁচাতে। ওটা আমি ভেঙে দিলেই তো নতুন
আসবে। আমার এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল আর তোমার
নতুন জিনিস পাওয়া , উইন উইন সিচুয়েশন। কিন্তু
না। ঝাঁপিয়ে পরে কাঁপিয়ে দিতে হবে। সেই লম্ফঝম্প
নেই , চ্যাঁচামেচি নেই। কি সুন্দর ঘুমোচ্ছে। এদিকে আমার ডাইপার ভারী হয়ে গেছে। খুব ভারী।
কালকে আবার খিচুড়ির সঙ্গে চিকেন ছিল। পরে হজমের জন্য ন্যাস্পাতি। রাতে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো বলে এক বোতল জল খেয়ে।
নিয়েছিলাম ব্যাস , সকাল হতে না হতেই সব হড়
হড় করে বেরিয়ে গেলো। এবার আমি ফাঁপরে। সেরিনের কথা মনে পরে গেলো। মা কে আজ হ্যাপি রাখতে হবে। আর আমি জানি মা ঘুমোতে দারুন ভালোবাসে। তাহলে কি করি।
আমি ঠিক করলাম তুলবো না। না হয় একটু
প্যাচপ্যাচেই লাগবে। আমি চুপ করে ভালো ছেলের
মতো পাশে বসে বসে মায়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগলাম।
কিছুক্ষন পর মা যখন উঠে পড়লো তখন
আমার শান্তি। ডাইপার খুলে দিতেই আমার রোজ ইচ্ছা করে ম্যাজিক কালার দিয়ে স্প্রে পেন্টিং
করতে। আজ আমি প্রানপনে সেই ইচ্ছা চেপে রাখলাম।
আজ আর নয়। দেখলাম আমার তুলি ঢাকা পরে
যাচ্ছে আসতে আসতে। ভেতর থেকে কেউ যেন বলে চলেছে , এখনো সুযোগ , এখনো
সুযোগ। কিন্তু না , আজ কিছুতেই না। মা কে খুশি করতেই হবে। এরপর আমি আপনমনে খেলতে লাগলাম। রোজ মা যখন রান্নাঘরে যায় তখন আমি সেখানে ঢুকে পায়ে পায়ে খেলি। ওই মা একটা পর্দার মতো কিছু একটা পরে থাকে। যেটা আমি হাত দিলেই দুলতে থাকে। আর মায়ের পায়ের লাল জুতোটা। আমার হেব্বি মজা লাগে। কিন্তু আজ আমি রান্নাঘরের দিকেই যায়নি।
আজ আমি কিচ্ছু ছুঁড়ে ফেলিনি। শুধু হালুমটা
আওয়াজ করছিলো না বলে একটু ধাক্কা দিয়েছি। রোজকারের
মতো আজ আর আমি লাইট টানাটানি করিনি। দাঁত ওঠার
সুড়সুড়ি লাগলেও আমি আজ কিচ্ছু চিবোই নি। রোজ
আমি উচ্চতায় বাড়ার চেষ্টা করি। সে গল্প পরে
একদিন। কিন্তু সেই চেষ্টার জন্য যা যা ওপরে
থেকে সেগুলো পরে যায়। মা রোজ সবকিছু তুলে তুলে
রাখে। আমি আজকে কোনো কিচ্ছু স্থানচ্যূত করিনি। আজ মেটিরিয়াল নয়। যা কিনতে পারা যায় সেসব নয়। ফোকাস করেছি যা ফিল করা যায় তার ওপর। সামার এসে গেছে। বাইরে সবুজ সবুজ ঘাস উঠছে , গাছে পাতা আসছে। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আমি তাই দেখেছি সারাদিন। আর সারাদিন
গলা ভেঁজেছি। নানা শব্দ , নানা আওয়াজ আর মাঝে
মাঝেই বলেছি , "মাম মাম , মাম মাম " আর
মা মাঝে মাঝেই এসে চটকে দিয়েছে আমায়। মা খুশি , মা খুশি আর কি চাই।
কিন্তু আজ আমি মা কে খুশি করার চক্করে
একটা গোটা দিন ওয়েস্ট করেছি। কাল পর্যন্ত চেষ্টা
করে করে সোফার ওপর দাঁড়িয়েছিলাম আজ ঝাঁপ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হলো না। এতদিন ধরে টিভির পেছনে ঢোকার চেষ্টা করছিলাম , আজ
সুযোগ ছিল কিন্ত ছেড়ে দিলাম। বাথরুমটা খোলা
ছিল , রিমোটটা কমোটে চোবানোর এক্সপেরিমেন্ট করার মহার্ঘ সুযোগ আমি আজ ছেড়ে দিয়েছি।
কাল পর্যন্ত ক্যালকুলেট করেছিলাম ডিসটেন্স বিটুইন টেবিল এন্ড খাট ইস ওয়ান জাম্প। আগে চেষ্টা করলেও মা ধরে নিতো। আজ চেষ্টাই করলাম না। একটা নতুন চটি কিনেছে মা। ওর গন্ধ নাকে আসছিলো , কি ইচ্ছা করছিলো চিবোতে।
কিন্তু না। রোজ বাবার রেখে যাওয়া বাক্সটা ঘাঁটতে
ঘাঁটতে অনেক কিছু শেখা যায় আজ সেটাতেও হাত দিইনি।
হাত, পা মন মাথা সব একসাথে নিশপিশ করছে।
কিন্তু শুধু মা কে খুশি রাখার জন্য আজ সব বিসর্জন।
সারাদিন ঠিক ছিল কিন্তু বিকেলে যখন
বাবার সাথে কথা বলি আজ দেখি মা চুপচাপ। এখানেও
আমি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে পাশে রাখা ফোনটা তুলে মায়ের হাতে দিলাম। মা দেখলাম ফোনটা পাশে রেখে আমায় কোলে তুলে জাপ্টে
ধরলো। ওমা কাঁদছো কেন? আমার ঘাড়ের কাছটা মায়ের
চোখের জলে ভিজে গেলো। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
গেলাম। এতো ঠিক নয়। আমি সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করলাম মা কে খুশি রাখার
জন্য। আমার সমস্ত ইচ্ছা , আনন্দ মাটিতে মিশিয়ে
দিয়ে আমি শুধু মা কে আজকের দিনটা খুশি রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্ত এ
কি ? মা কাঁদছে। তাহলে নিশ্চই মায়ের কোথাও
লেগেছে। আমার যখন লাগে তখনি তো আমি কাঁদি। মায়ের কল থেকে নেমে গিয়ে মায়ের সারা গায়ে দেখলাম। কিন্তু না তো , কোথাও তো লাল বা কালো হয়ে যায়নি।
তাহলে ? দাদু বলে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে লাগলে যন্ত্রনা হয় কিন্তু দেখা যায় না। কিন্তু সেই জায়গাগুলো কি ? আমি নেমে গেলেও দেখলাম
মা ফোন হাতে নিয়ে কি একটা টাইপ করে যাচ্ছে আর কেঁদে চলেছে। বাবার সাথে কথা বলছে নাকি রে বাবা। কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম বাবা বলেছে আবার আসতে
আরো দেরি হবে , তাই মা কাঁদছে।
এবার যারা আমার ডায়েরি পড়ছো সবাই
আবার প্রথম থেকে পড় এই পাতাটা। এবার বলো আমি
কি করি। আমি যদিও এই মাদার্স ডে কিছুতেই মানিনা,
তবুও সোশ্যাল রিলেসন মেন্টেন করতে আমি কি চেষ্টা করিনি। তোমরা সোসাইটি বানিয়েছো , রুল বানিয়েছো , দেশ বানিয়েছো
, ইমিগ্রেশন বানিয়েছো আর আমি যে তোমাদের নিয়ম মেনে মানে খুশি করার চেষ্টা করলাম তা
তোমাদের রুলের জন্য এক নিমিষে ভেঙে গেলো। এ
কেমন ধারা কথা। হেব্বি অকওয়ার্ড হেল্পলেস লুক
নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ক্যাবলা ক্যাবলা হাসি দিলাম। মা বুঝলো কি বুঝলো না জানিনা, আবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে
কাঁদতে আমায় দাদুর হাতে ট্রান্সফার করে বাথরুমে ঢুকে গেলো। যদিও মা কিছু বুঝলো না তবুও আমি চিৎকার করে বললাম
, "মা আমার তরফ থেকে সব চেষ্টা করবো যাতে প্রত্যেক দিন যাতে তোমার দিন হয়। কিন্তু আমি সবাই কে ঠিক করতে পারবো না। তাই অন্যের কাছ থেকে যে দুঃখ তুমি পাচ্ছ তার জন্য
আমি শুধু সরি বলতে পারি। কেঁদোনা মা , আমি
এখনো আছি তোমার সাথে, তোমার কাছে। হ্যাপি মাদার্স ডে।"
No comments:
Post a Comment